বাংলা ভাষায় জুমার খুতবা দান সুন্নাতের বরখেলাফ
----------------------------------------
১৪০২ হিজরী সালে পবিত্র মক্কায় অনুষ্ঠিত রাবিতা আলম আল-ইসলামী পঞ্চম ফিকাহ অধিবেশনের অভিমত: ‘অনারবদের বেলায় সূচনা-সমাপন ও আয়াত-হাদীসসমূহ আরবিতে পাঠ করে প্রাসঙ্গিক বিষয় তাদের ভাষায় খুতবা দান করা যায়।’
বক্ষ্যমান নিবন্ধে আমার অপরিসর অধ্যাবসায়ের আলোকে কুরআন-সুন্নাহ, ফিকাহ-উসুলে ফিকাহ, ইতিহাস ও বরেণ্য মনীষীগণের দৃষ্টিতে ঈদ ও জুমায় বাংলা খুতবাদান বিষয়ক বিতর্কটির অবসান ও অপনোদনের প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
আল-কুরআনের আলোকে
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اِذَا نُوْدِيَ لِلصَّلٰوةِ مِنْ يَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا اِلٰى ذِكْرِ اللّٰهِ وَذَرُوا الْبَيْعَؕ ۰۰۹
‘হে ঈমানদারগণ। যখন জুমার আযান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর যিক্রের দিকে অগ্রসর হও এবং কেনাকাটা (ইত্যাদি) পরিত্যাগ করো।’
এখানে যিক্র অর্থ খুতবা বা নামায। মূলত যিক্র শব্দটি দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়: ১ সাধারণ আনুগত্য ও ২. যিক্র। বলাবাহুল্য আকীদার কিতাবে রয়েছে যিক্র মনসূস আলাই বা কুরআন-হাদীস বর্ণিত পন্থা ও পদ্ধতিতে সম্পাদন করা আবশ্যক। কাজেই জুমা ও ঈদের খুতবা মহানবী থেকে বর্ণিত পদ্ধতি অর্থাৎ আরবিতেই হতে হবে। অন্য কোনো ভাষায় নয়।
হাদীসের আলোকে
খুতবা মুখ্যভাবে যিক্র আর গৌণভাবে ভাষণ বা ওয়ায-উপদেশ। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ‘ইমাম যখন (খুতবার জন্য) বের হন তখন ফেরেশতারা যিক্র অর্থাৎ খুতবা শোনার জন্যে হাজির হন।’
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘ইমাম যখন বের হন, ফেরেশতারা তখন স্ব-স্ব খাতা বন্ধ করে মনোযোগ-সহকারে যিক্র বা খুতবা শুনেন।’
রাসূল -এর খুতবায় ওয়ায-নসীহতের বাণী অবশ্যই ছিল। অতএব হাদীসের আলোকে দেখা যায়, খুতবা আসলে যিক্র হিসেবে নবী করীম যে ভাষায় দিয়েছিলেন সে ভাষাতেই হতে হবে। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী বলেন, যুগযুগান্তরে মুসলমানদের রীতি-নীতি হচ্ছে আরবি ভাষায় খুতবাদান করা। অথচ অনেক দেশে অনারবি লোক বিদ্যমান ছিল। কাজেই জুমা ও ঈদের খুতবা আরবি ভাষায় প্রদান করা সুন্নাত, অন্য ভাষায় বিদআত [মুসাফ্ফাহ শরহে মুওয়াত্তা]।
হাদীসের প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার ইমাম নববী বলেন, জুমা ও ঈদের খুতবা হাদীসের গ্রন্থাবলির সোনালি পাতায় আজো হুবহু শোভা পাচ্ছে। তাতে দেখা যায়, শ্রোতাদের মধ্যে বিভিন্ন ভাষার লোক থাকা সত্ত্বেও নবী করীম খুতবায় দু’ভাষী কিংবা অনুবাদকের ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। আরবিতেই খুতবা দিয়েছিলেন। আর শ্রোতৃমণ্ডলী না বুঝলেও মনোযোগ-সহকারে যিক্র শুনেছিলেন।
ফিকহের আলোকে
ইমাম মালিক , ইমাম শাফিয়ী , ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল , ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ -এর মতে খুতবা অবশ্যই আরবিতে প্রদান করতে হবে। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা ফারসি (অনারবী) ভাষায় খুতবাদান জায়িয বলে অভিমত পোষণ করেন।
আল্লামা শুররুমবুলালী -এর মতে জুমার খুতবার ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা স্বীয় মতের ওপর অটল ছিলেন, শিষ্যদ্বয়ের মতামতের ওপর রুজু করেননি।
.....
শায়খ আবদুল হক দেহলবী বলেন, আরবি ভাষায় খুতবাদান সর্বোত্তম। যদিও ইমাম আবুহানিফা যেকোনো ভাষায় তা জায়িয বলে থাকেন।
সৌদি আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতী শায়খ আবদুল আযীয ইবনে বায জনৈক প্রশ্নকারীর জওয়াবে বলেন, হ্যাঁ আরবিতে খুতবা দেবেন। তবে শ্রোতাদের ভাষায় পূর্বাপর বুঝিয়ে দেবেন।
রেন।
উসূলে ফিকহের আলোকে
উসূল বা ফিকহের মূলনীতির আলোকে আরবি ভাষায় খুতবা অকাট্য ও অলঙ্ঘনীয় সুন্নাত। কেননা মহানবী খুলাফায়ে রাশিদীন অন্যান্য সাহাবা, তাবেঈন, তবে তাবেঈন অর্থাৎ ইসলামের সোনালি সর্বদা আরবি ভাষায় খুতবাদান করা হত বিধায়, এটি সুন্নাতে নবী । সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশিদীন, সুন্নাতে মুতাওয়াতেরা (নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিক সুন্নাত) ও সুন্নাতে মুতাওয়ারিসা (বা যুগপরম্পরা সুন্নাত)।
ইতিহাসের আলোকে
ইতিহাস সাক্ষ্য, সাহাবা, তাবেঈন এবং অপরাপর ইসলামের সিপাহসালার ও শাসকগণ বিজিত অনারব দেশসমূহে শ্রোতাদের প্রয়োজন এবং অনারবি ভাষায় তাদের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বে¡ও কেউ কোথাও অনারবি ভাষায় খুতবাদান করেছিলেন বলে কোন প্রমাণ নেই। সপ্তম শতকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আগত সাহাবা প্রতিনিধি দল, অতঃপর মেঘনার মোহনা থেকে সুদূর কক্সবাজার পর্যন্ত ব্যাপক বিচরণকারী আরব বণিক তথা দীনপ্রচারক দলসমূহ এবং বাংলার বিখ্যাত ধর্মপ্রচারক হযরত শাহ জালাল, নূর কুতবে আলম, শায়খ শারফুদ্দিন ইয়াহয়া মানিরী ও খান জাহান আলী সহ অগণিত অলি-দরবেশ বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। তারা এখানকার মাতৃভাষায় দাওয়া কর্মপরিচালনা করেছিলেন বলে ড. এবনে গোলাম সামাদ, ড. এনামুল হক ও মাওলানা আবদুল মান্নান তালিব প্রমুখ অভিমত প্রকাশ করেন, কিন্তু কোন প্রচারকর্মী সমসাময়িক নব-মুসলিমদের কাছে বাংলায় খুতবাদান করেছিলেন বলে আদৌ প্রমাণ নেই। নচেৎ আজকের পুরাতন মুসলিমদের মধ্যে নতুন করে এ বিতর্ক দেখা দিত না।
খুতবা যিক্র না ভাষণ
আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ শফী বলেন,.........খুতবার আসল উদ্দেশ্য যিক্র বা বিশেষ ইবাদত। ওয়ায-উপদেশ গৌণভাবে লাভ হয়। কেননা
১. খুতবায় দুইটি ফরয এবং পনেরটি সুন্নাত রয়েছে [আলমগীরী, খ. ১, পৃ. ১৪৬]।
২. জুমার খুতবা হচ্ছে চার রাকাত বিশিষ্ট যোহরের ফরযের বাকী দুই রাকাত নামায [বাহার, খ. ১, পৃ. ১০৮]।
৩. খুতবার মাঝখানে কথা বলা যাবে না।
৪. খুতবা জুমার জন্য শর্তবিশেষ [ফাতহুল কদীর]।
৫. খুতবার সময় নামায পড়া, কথা বলা, তাসবীহ-তাহলীল করা, সালাম দেওয়া, হুযুর -এর নাম শুনলে দরূদ পাঠ করা এবং অন্যায় কাজে মৌখিক নিষেধ করা সবকিছুই নিষিদ্ধ [হিদায়া ও বাহার]। অথচ ওয়ায-বক্তৃতায় এগুলো নিষিদ্ধ নয়। আর না ওয়াযের জন্য কিছু ফরয ও সুন্নাত রয়েছে। না ওয়ায জুমার জন্য শর্ত স্বরূপ। কাজে এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, খুতবা প্রচলিত ওয়ায-বক্তৃতা নয়। বরং বিশেষ যিক্র যা ইমাম সাহেব উচ্চৈঃস্বরে করেন আর শ্রোতৃমণ্ডলী না বুঝলেও তা মনোযোগ-সহকারে শুনেন।
(খ) নবী করীম -এর খুতবায় রোম, পারস্যসহ বিভিন্ন অনারব দেশের লোক শরীক হত। তখন সাহাবীদের মধ্যে অনুবাদকর্মে সক্ষম ব্যক্তি অনেক বিদ্যমান ছিলেন। খুতবা প্রচলিত ওয়ায-বক্তৃতা হলে রাসূল নিঃসন্দেহে অনুবাদের ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু খুতবার ব্যাপারে তা করেছিলেন বলে ইতিহাসে কোথাও প্রমাণ নেই। নবী করীম -এর পরে সাহাবীগণ বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় অনারব দেশ সমূহে ঢুকে পড়েন এবং বিজিত এলাকায় সর্বত্র জুমা ও ঈদ কায়েম করেন। প্রাদেশিত গভর্ণরগণ রাষ্ট্রীয় কাজে দু’ভাষী ব্যবহার করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস দাওয়া কর্মের জন্যে বেতনধারী একজন দু’ভাষী রেখেছিলেন [সহীহ আল-বুখারী]। কিন্তু তারা অনারবী ভাষায় কখনো খুতবা দেননি। আর না কেউ খুতবার কাজে কোন দু’ভাষীকে ব্যবহার করেছিলেন। কাজেই বুঝা গেল খুতবা নামাযের ক্বেরাত, তাসবীহ, তাশাহুদ ইত্যাদির ন্যায় যিক্র বিশেষ। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন:
১. খুতবা না বুঝলে শুনে লাভ কি? এ জবাবে বলতে হয় তাহলে নামাযের কিরাআত, তাশাহুদ, তাকবীর ইত্যাদিও অনুবাদ করতে হবে,
২. খুতবা বক্তৃতা না হলে খতীব সাহেব শ্রোতামুখী হন কেন? এর তিনটি জবাব।
১. ভাষা এমন একটি সেতু যদ্বারা এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশে অনায়সে পারাপার হয় (উদাহরণ-স্বরূপ ইংরেজি ভাষাকে পেশ করা যেতে পারে) তাই শ্রেষ্ঠ ভাষা বিজ্ঞানী মুহাম্মদ কুরআনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি সারা বিশ্বে বিস্তার করার উদ্দেশ্যে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দাড়িয়ে কুরআন-সুন্নাহ এর আরবিতেই খুতবা প্রচলন করেন।
২. খুতবা নামক যিক্রটির প্রকৃতিই হলো ইমাম সাহেব দাঁড়িয়ে খুতবা দেবেন-যিক্র করবেন। আর শ্রোতারা নিরবে তা শ্রবণ করবেন। বস্তুত খুতবার ব্যাপারে মহানবী ও ইসলামের সত্যযোগে প্রচলিত পদ্ধতি-পন্থায় আপত্তি করা কোনো মুমিনের জন্য শোভা পায় না।
৩. আরবি ভাষা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও বিশ্বনবী সুন্নাহের ভাষা হিসাবে একটি বিশ্বজোড়া আন্তর্জাতিক ভাষা, তাই আরবির এই আন্তর্জাতিক মান বহাল রাখার উদ্দেশ্যে মহানবী সপ্তাহ ও বছরান্তে আরবি ভাষায় শোডাউন করার প্রতিবিধান প্রবর্তন করেন। যা মুসলমানদের জন্য আপত্তির বিষয় নয়, বরং গর্ব ও গৌরবের বিষয়।