★بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيم★لآ اِلَهَ اِلّا اللّهُ مُحَمَّدٌ رَسُوُل اللّهِ★اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ★
YaNabi.in
কুরবানি (ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আহকাম) - Mas'la Masayel Discussions on

কুরবানি (ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আহকাম)

edited August 2016 in Mas'la Masayel
কুরবানি (ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আহকাম) 
بسم الله الرحمن الرحيم * نحمده و نصلي ونسلم علي رسوله الكريم

নির্দিষ্ট পশুকে নির্দিষ্ট দিনে (অর্থাৎ ১০ যুলহাজ্জ্ব থেকে ১২ যুলহাজ্জ্ব) আল্লাহ’র নৈকট্য অর্জন এবং ছাওয়াবের নিয়্যতে নির্দিষ্ট পশু জবাই করা হল কুরবানি। যা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নাত। হুযুর পুর নুর সরকারে দু’আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কেও এ ব্যাপারে বলা হয়েছে যে-

فصل لربك وانحر

অর্থাৎ, সুতরাং আপনি স্বীয় রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়–ন এবং কুরবানি করুন। (সূরা আল-কাউছার : ০২)

কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদতে মালি (সম্পদের মাধ্যমে ইবাদত)’ এবং এটি ইসলামের একটি শে‘য়ার বা নিদর্শনও বটে। হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরতের পর ১০ বছর পর্যন্ত মদিনা তৈয়্যেবায় অবস্থান করেছেন এবং প্রতি বছরই কুরবানি করেছেন। এ থেকে বুঝা যায়, কুরবানি শুধু হজ্জ্ব পালনের সময় মক্কা মু‘য়ায্যমার জন্যই নির্দিষ্ট নয়, বরং শরিয়ত কর্তৃক নির্দিষ্ট পরিমাণ (নিসাব পরিমাণ) সম্পদের মালিক সকল ব্যক্তির জন্যই কুরবানি করা ওয়াজিব; সে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন।

হাদিস অস্বীকারকারী কথিত মুক্তমনা মুসলমান, যারা এ ব্যাপারে আপত্তি করে থাকে যে, “এ কুরবানির জন্য অনেক পয়সা খরচ হয়; কাজেই এতে খরচ না করে জনকল্যানমূলক কাজ যেমন- শরণার্থী শিবির, দাতব্য হাসপাতাল প্রভৃতি নির্মাণ করে দেয়া উচিত,” তাদের এ আপত্তিটি শুধু খামখেয়ালীবসত মনগড়াই মাত্র। অন্যথায় হজ্জ্বও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে মালি এবং ইসলামের অন্যতম একটি নিদর্শন, এটাও এ বলেই বন্ধ করে দিতে হবে যে- “লাখ-লাখ টাকা প্রত্যেক বছর হজ্জ্বের জন্য খরচ না করে এগুলো জনকল্যানমূলক কাজে ব্যয় করাই বেশি উত্তম হবে। এভাবে রবের বিধান উপেক্ষা করে ইসলামের নিদর্শনসমূহের সবক’টি বাদ দেয়াটা আর যাই হোক অন্তত কোন মুসলমানের কাজ হতে পারে না।

আর শুধু এ বলা যে- “কুরবানি কেবল মাত্র হজ্জ্বের সময় মক্কা মু‘য়ায্যমাই হবে, অন্যত্র অন্য কোন সময় নয়”- তাও মারাত্মক ভুল এবং পবিত্র হাদিসের অস্বীকারের নামান্তর। অবশ্যই হজ্জ্বের কুরবানি নিঃসন্দেহে মক্কা মু‘য়ায্যমার জন্যই নির্দিষ্ট। কিন্তু ঈদুল আদ্বহা’র কুরবানি প্রত্যেক নির্দিষ্ট পরিমাণ (নিসাব পরিমাণ) সম্পদের মালিকের উপরই ওয়াজিব; সে যেখানেই অবস্থান করুক।

কুরবানি করা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নাত

হাদিস শরিফে এসেছে, হযরত যায়দ বিন আরক্বাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, সাহাবা কিরাম একবার আল্লাহ’র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আরয করলেন-

يا رسول الله ما هذا الاضاخي قال سنة ابيكم ابراهيم عليه السلام

(ইয়া রাসুলাল্লাহ্! এ কুরবানিটা কি? তিনি ইরশাদ করলেন- “তা তোমাদের পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নাত”)। (ইবনু মাজাহ)

কুরবানি করা সায়্যিদুল আম্বিয়া হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত

হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-

ذبح النبي صلي الله عليه وسلم يوم الذبح كبشين اقرنين املحين موجوئين

অর্থাৎ, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানির দিন চিত্রা রংয়ের শিংবিশিষ্ট দু’টি খাসি কুরবানি করেছেন। (আবু দাউদ, মিশকাত)

বুঝা গেল, কুরবানি করা আমাদের প্রিয় নবিজিরও সুন্নাত। অন্য হাদিসে এসেছে যে, হুযুর পাকের কুরবানির পশুর বৈশিষ্ট্য ছিল- হৃষ্টপুষ্ট, শিংবিশিষ্ট, অধিক গোশ্তসম্পন্ন, চিত্রা রংয়ের এবং অন্ডকোষ কর্তৃত (খাসি)। (ইবনু মাজাহ)

কুরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানি

মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানি হল, হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর দুই পূত্র হাবিল ও কাবিল-এর প্রদত্ত কুরবানি। পবিত্র কুরআন কারিমে বর্ণিত হয়েছে-

واتل عليهم نبأ ابني آدم بالحق اذ قربا قربانا فتقبل من احدهما ولم يتقبل من الاخر

অর্থাৎ, আদমের দুই পূত্রের বৃত্তান্ত আপনি তাদেরকে যথাযথভাবে (যেমনটি ঘটেছিল) শুনান, যখন তারা উভয়ে কুরবানি করেছিল, তখন তাদের একজনের কুরবানি কবুল হল এবং অপরজনের কবুল হলনা। (সূরা আল্-মা-ইদাহ : ২৭)

সংক্ষেপে ঘটনাটি হল, হযরত মা হাওয়া-এর গর্ভে হাবিলের সাথে ‘লিওয়া’ আর কাবিলের সাথে ‘এক্বলিমা’ জন্মগ্রহন করেন। আর ঐ শরিয়তের বিধি অনুযায়ী ‘এক্বলিমা’ কাবিলের জন্য হারাম ছিল, তার জন্য হালাল ছিল ‘লিওয়া’। কিন্তু ‘এক্বলিমা’ অধিকতর সুন্দরী হওয়ায় কাবিল তাকেই বিয়ে করতে চাইল। হযরত আদম আলাইহিস সালাম নিষেধ করলে কাবিল বলল, এটা আপনার নিজস্ব অভিমত, রবের হুকুম নয়। তখন তিনি বললেন, তোমরা দু’জনেই কুরবানি কর, যার কুরবানিকে আগুন এসে জালিয়ে দিয়ে যায় সেই সত্য। সুতরাং কাবিল গমের স্তুপ আর হাবিল উট কিংবা দুম্বা জবাই করে পাহাড়ের উপর রাখল। অদৃশ্য আগুন এসে হাবিলের গোশতগুলো জালিয়ে দিয়ে গেল, আর কাবিলের গমগুলো এমনি পড়ে রইল। এটা দেখে কাবিল হিংসায় জ্বলে উঠল।

এ ছিল মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানি এবং কুরবানি করার পদ্ধতি।

কুরবানি পূর্ববর্তী সকল যুগেই ছিল

এ কুরবানির বিধান যুগে যুগে রবের পক্ষ হতে অবতীর্ণ সকল শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

ولكل امة جعلنامنساكا ليذكروا اسم الله علي مارزقهم من بهيمة الانعام

অর্থাৎ, আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর উপর তারা আল্লাহ’র নাম উচ্চারণ করে। (সূরা আল-হাজ্জ্ব : ৩৪)

মানুষের সবচেয়ে প্রিয় দু’টি বস্তু এবং এর কুরবানি

আল্লাহ তা‘য়ালার যে যত নিকটে, যে যত প্রিয় তাঁর পরীক্ষাগুলো ততই কঠিন হয়ে থাকে। তা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত। পবিত্র কুরআন কারিমেও এসেছে-

ولنبلونكم بشيء من الخوف والجوع ونقص من الاموال والانفس والثمرات وبشر الصابرين

অর্থাৎ, আর অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুদা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে; তবে সুসংবাদ দিন ধৈর্য্যশীলদের। (সূরা আল-বাক্বারা : ১৫৫)

হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহ পাক স্বীয় খলিফা হিসেবে মনোনিত করেছেন। কাজেই তাঁকে এমন দু’টি বিষয়ের কুরবানি করার মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়েছেন, যে দু’টি বস্তু মানুষের সবচেয়ে প্রিয়।

প্রথমটি হল, তাঁর জান;

দ্বিতীয়টি হল, তাঁর সন্তান।

আল্লাহ তা‘য়ালা স্বীয় নবি ইব্রাহিম খলিল আলাইহিস সালাম-কে এ দু’টি বিষয়ের মাধ্যমেই পরীক্ষা নিয়েছেন এবং তিনি দু’টিতেই অত্যন্ত সাফল্যের সাথে কামিয়াব হয়েছেন।

জানের কুরবানির মাধ্যমে পরীক্ষা

আল্লাহ’র নবি হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহ’র দ্বিনের দাওয়াত দিতে লাগলেন। এতে নমরূদ ক্ষিপ্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে, তাঁকে সম্পূর্ণ বিলীন করে দিতে হবে। সে অনুযায়ী নমরূদের প্রজ্জ্বলিত আকাশচুম্বী আগুনের লেলিহান শিখায় ফেলার জন্য খলিলুল্লাহকে চাক্কিতে ঘুরানো হচ্ছিল অথবা মিনজানিক দ্বারা নিক্ষেপ করার আয়োজন করছিল। কাফেররা উল্লাসে মেতে উঠল যে, আজ থেকে তাদের কথিত মা‘বুদদেরকে গালী দেয়ার আর কেউ থাকবে না, চিরদিনের জন্য তাঁকে ধ্বংশ করে দেয়া হবে। এদিকে জিব্রাইল আলাইহিস সালাম উপস্থিত হয়ে গেলেন। বললেন, হে আল্লাহ’র খলিল! কোন নির্দেশ কি আছে? কিংবা কোন প্রয়োজন? আল্লাহ’র নবি খলিল বললেন, তোমার কাছে আমার কোন প্রয়োজন নেই। জিব্রাইল বললেন, তবে রবের নিকটই আবেদন করুন। তিনি বললেন-

جانتا ہےوہ مرا رب جلیل آگ مین پرتاہے اب اسکا خليل

“তিনি আমার পরাক্রমশালী রব, তিনি জানেন যে, এখনই তাঁর বন্ধু আগুনে পড়ছেন।”

এদিকে আল্লাহ’র নবি ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম-কে আগুনে নিক্ষেপ করা হল, ঐদিকে আল্লাহ তা‘য়ালা আগুনকে আদেশ করলেন-

يا نار كوني بردا وسلاما علي ابراهيم

অর্থাৎ, হে অগ্নি! তুমি ইব্রাহিমের উপর আরামদায়ক শীতল হয়ে যাও। (সূরা আল-আম্বিয়া : ৬৯)

আল্লাহ’র নবি খলিল আলাইহিস সালাম প্রথম এবং সবচেয়ে প্রিয় জানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।

সন্তানের কুরবানির মাধ্যমে পরীক্ষা

জানের কুরবানির পর এখন প্রিয় সন্তানের কুরবানি। আল্লাহ’র আদেশে জনমানবহীন, পানি-রসদবিহীন, গাছ-গাছালীশূণ্য কঠিন মরু প্রান্তরে নির্বাসন দিয়ে আসলেন স্ত্রী হাজেরাসহ প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম-কে। পরীক্ষার শুরু এখান থেকেই। আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে খাদ্য-পানীয়, গাছ-গাছালী ও মানুষের বসতি বানিয়ে দিলেন সে মরুময় মক্কাকে ইসমাইল নবির বরকতে। তিনি আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলেন। যখন হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম যৌবনে পদার্পনের কাছাকাছি হলেন, পিতা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম একাধারে তিনদিন স্বপ্নে দেখলেন যে, আল্লাহ পাক তাঁর নিকট প্রিয় সন্তানের কুরবানি তলব করছেন। তৃতীয় দিন সকাল বেলা হযরত হাজেরা’র নিকট থেকে সাজিয়ে গুছিয়ে, উত্তম পোষাক পরিয়ে ছুরি এবং রশি সাথে করে ইসমাইল আলাইহিস সালাম-কে নিয়ে রওনা দিলেন জংগলের দিকে।

শয়তান ধোঁকা দেয়ার নিমিত্তে হযরত হাজেরা, ইসমাইল এবং ইব্রাহিম নবির নিকট ক্রমান্বয়ে গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে আসল। হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ইসমাইল আলাইহিস সালাম-কে যা বললেন এবং ইসমাইল আলাইহিস সালাম-এর জবাব যা ছিল পবিত্র কুরআন কারিমে আল্লাহ পাক তা এভাবে চিত্রায়ণ করেছেন যে-

فلما بلغ معه السعي قال يبني اني اري في المنام أني اذبحك فانظر ماذا تري قال يأبت افعل ما تؤمر ستجدوني ان شاء الله من الصابرين

অর্থাৎ, অতঃপর যখন সে পিতার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হল, ইব্রাহিম তাঁকে বললেন, হে বৎস! স্বপ্নে আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে যে, আমি তোমাকে জবাই করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বলল, পিতা! আপনার প্রতি যা ওহি হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করুন। আল্লাহ চাহে তো আমাকে ধৈর্য্যশীল হিসেবে পাবেন। (সূরা আস-সাফ্ফাত : ১০২)

ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম-এর কুরবানি কবুল এবং বর্তমান কুরবানির প্রচলন

কেমন আশ্চর্য্যরে দৃশ্য! আল্লাহ’র সন্তুষ্টির জন্য পিতা কর্তৃক পূত্রকে কুরবানি!! (আল্লাহু আকবার)। যখন পিতা-পূত্র উভয়েই রবের ফায়সালার উপর অবনতচিত্তে রাজী, তখন পিতা পূত্রকে উপূরকরে শোয়ালেন। কুরআনের ভাষায়- فلما اسلما وتله للجبين (যখন পিতা-পূত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহিম তাঁকে জবাই করার জন্য শায়িত করলেন)। (সূরা আস-সাফ্ফাত : ১০৩)

ছুরি চালাবার আগে পূত্র বলল, আব্বাজান! তিনটি আবদার রক্ষা করুন-

প্রথমত, আমার হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে দিন, যেন নড়াচড়ার কারনে আপনার কষ্ট না হয় এবং আপনার শরীরে রক্তের ছিটা না পড়ে।

দ্বিতীয়ত, আমার চোখে কাপড় বেঁধে দিন, যেন মহাব্বতের আতিশয্যে ছুরি চালানো বন্ধ না হয়ে যায়।

তৃতীয়ত, আমার রক্ত মাখা জামাটি আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিবেন, যেন তাঁর অন্তরে একটু স্বস্তি আসে।

এদিকে পিতা পূত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছেন, ঐদিকে ছুরি ভোতা হয়ে গেছে। দু’বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ছুরিটি যখন পাহাড়ের দিকে নিক্ষেপ করলেন, তখন একটি পাথরের উপর পড়ে তা ছুরির আঘাতে দু’খন্ড হয়ে যায়। ছুরির বক্তব্য-

الخليل يأمرني بالقطع والجليل ينهاني

অর্থাৎ, খলিল আমাকে কাটতে হুকুম করেন, আর জলিল (আল্লাহ) আমাকে নিষেধ করেন।

আবার ছুরি হাতে যখন পূত্রকে জবাই করতে প্রস্তুত হলেন, তৎক্ষনাৎ জিব্রাইল আমিন বেহেশত হতে একটি দুম্বা নিয়ে ইব্রহিম আলাইহিস সালাম-এর ছুরি ইসমাইল আলাইহিস সালাম-এর গলায় পৌঁছার আগেই হাজির হলেন এবং ইসমাইল আলাইহিস সালাম-কে সরিয়ে তদস্থলে দুম্বাটি রেখে দিলেন। দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল। রবের পক্ষ হতে আওয়াজ আসল-

ونديناه ان يابراهيم قدصدقت الرءيا انا كذالك نجزي المحسنين ان هذا لهو البلاؤا المبين وفديناه بذبح عظيم وتركنا عليه في الاخرين

অর্থাৎ, তখন আমি তাঁকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম! তুমিতো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দেই। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম জবাই করার জন্য এক মহান জন্তু। আমি তার জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি। (সূরা আস-সাফ্ফাত : ১০৪-১০৮)

জ্ঞাতব্য যে, ইবনু কাছির বর্ণনা করেন, হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম-এর পরিবর্তে জান্নাতি যে দুম্বা বা ভেড়াটি দান করা হয়েছিল, এর নাম জারির, রং ছিল সাদা, বড় বড় চক্ষু ও শিং বিশিষ্ট। এটা জান্নাতে ৪০ বছর প্রতিপালিত হয়েছিল। এটা সে জন্তু যা হযরত আদম আলাইহিস সালাম-এর বড় ছেলে হযরত হাবিল কুরবানি করেছিলেন।

হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম-এর কুরবানি আল্লাহ কবুল করে নিলেন, আর এ স্মরণিকা স্বরূপ সেই কুরবানি ধারা কিয়ামত পর্যন্ত জারি করে দিলেন। এখনো প্রতি বৎসর সে স্মরণকেই উজ্জীবিত করা হয়।

জিব্রাইল আলাইহিস সালাম-এর পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ

ফাতহুল বারি শারহুল বুখারি এবং আইনি শারহুল বুখারিতে এসেছে যে, একবার হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিব্রাইল আমিনকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কখনো তোমার পূর্ণাঙ্গ শক্তি প্রয়োগ করেছ? জবাবে জিব্রাইল আমিন বললেন, আমি চার বার আমার পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করেছি।

প্রথমবার, ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছিল তখন আমি সিদরাতুল মুনতাহায় ছিলাম, আল্লাহ’র আদেশে ততক্ষনাৎ আমি তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করার পূর্বেই হাজির হয়ে যাই এবং আগুনকে ফুলবাগানে পরিণত করে দেই।

দ্বিতীয়বার, আমি সিদরায় ছিলাম, ছুরি হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম-এর দিকে আসছিল। মাত্র দু’ফুট দুরত্বের ব্যবধান এবং ছুরি সে দু’ফুট অতিক্রম করার আগেই জান্নাত হতে দুম্বা নিয়ে সেখানে পৌঁছাই।

তৃতীয়বার, ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে যখন তাঁর ভাইয়েরা কূপে ফেলে দেওয়ার জন্য তাঁর বাহুতে রশি বেধে কূপের ভেতরে ঝুলিয়ে দিল এবং তরবারী দিয়ে রশি কাটতে এখনো অর্ধেক বাকী, তখন রবের আদেশ হলো এবং আমি জান্নাত হতে তখ্ত এনে তিনি নিচে পড়ার পূর্বেই বিছিয়ে দিলাম।

চতুর্থবার, উহুদ যুদ্ধে যখন ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার দাঁত মুবারক শহিদ হলো, জমিনে আপনার রক্ত মুবারক পড়তে ছিল, তখন আল্লাহ পাক আদেশ করলেন, হে জিব্রাইল সিদরা থেকে তারাতারি যাও এবং আমার হাবিবের রক্ত মুবারক মাটিতে পড়ার পূর্বেই সংরক্ষণ কর; না হয় জমিন পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাবে। তখন আমি এসে তা সংরক্ষণ করি।

উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র প্রত্যাবর্তনের ক্ষমতা

এতক্ষন দেখলেন জিব্রাইল ফেরেশতা’র প্রত্যাবর্তনের ক্ষমতা। এখন একটি দৃষ্টি দিন উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র প্রত্যাবর্তনের ক্ষমতার প্রতি-

* হযরত আব্দুল আযিয দাব্বাগ মাগরিবি রাদ্বিযাল্লাহু আনহু সম্পর্কে প্রসিদ্ধ যে, একদিন তিনি ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি পা উঠাতেন কিন্তু মাটিতে রাখার পূর্বেই পুনরায় ফিরিয়ে নিতেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত এমনটি করছিলেন। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল যে, এটা কি কাজ? আপনি পা উঠাচ্ছেন কিন্তু জমিনের উপর রাখছেন না। তিনি বললেন-

گفتند کہ زمین اولیاء را دو قدم ست مرا یک قدم میسر نمی شد

(বলা হয় যে, জমিন অলিগণের দুই কদমের জায়গা কিন্তু আমি এক কদমও রাখার জায়গা পাচ্ছি না। পা উঠালেই জমিনের উপারে চলে যায়। (বারাহ্ তাক্বরীরী)

* এদিকে হুযুর গাউসুল আ‘যম আবদুল কাদের জিলানি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন-
نظرت الي بلاد الله جمعا * كخردلة علي حكم اتصال

অর্থাৎ আমি আল্লাহ’র সকল সম্রাজ্যে নজর করলাম, যেন তা শরিষার দানার ন্যায় পরস্পর সন্নিবেশিত হয়ে আছে। (কাছিদায়ে গাউছিয়া)

* এদিকে ফাতাওয়ায়ে শামিতে উল্লেখ রয়েছে যে-

وطي المسافة منه لقوله عليه السلام زويت لي الارض ويدل عليه ما قالوا فيمن كان في المشرق وتزوج إمرأة بالمغرب فأتت بولد يلحقه وفي التتارخانية ان هذه المسئلة تؤيد الجواز

অর্থাৎ এই দূরত্ব অতিক্রম করাটা সে একই কারামতের অন্তুর্ভূক্ত। এটা এজন্য সম্ভবপর যে, হুযুর আলাইহিস সালাম ইরশাদ করেছেন, আমার জন্য পৃথিবীকে সংকুচিত করে দেওয়া হয়েছে। এতে ফক্বিহগণের এ মাসআলাটিরও সমাধান হয়ে যায় যে, পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে অবস্থানকারী কোন ব্যক্তি (আল্লাহ’র ওলি) যদি পশ্চিম প্রান্তে অবস্থানকারী কোন মহিলাকে বিবাহ করেন এবং এ অবস্থায় স্ত্রীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, তাহলে ঐ শিশুটি উক্ত স্বামীর বলেই গণ্য হবে। তাতারখানিয়া নামক গ্রন্থে আছে যে, মাসআলাটি কারামতের বৈধতাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। (শামি, তৃতীয় খন্ড, কারামত অধ্যায়)

আল্লাহ’র ওলিগণের ক্ষমতা হচ্ছে যে, পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তের দূরত্বতা তাঁদের জন্য কোন প্রতিবন্ধকই নয়।

হুযুর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আল্লাহ’র সৃষ্টি জগত

নবি পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

زوي لي الارض

অর্থাৎ, নিশ্চই আল্লাহ আমার জন্য জমিন সংকুচিত করে দিয়েছেন। (মুসলিম)

হুযুর পাকের খাদেম জিব্রাইল, গাউছে পাক ও অন্যান্য উম্মতের জন্য যদি আল্লাহ’র সকল সৃষ্টি জগত এত ছোট হয়, স্বয়ং সেই দয়াল মুনিব আক্বা-মাওলার জন্য ছোট করা হলে তা কতটুকু ছোট হবে, যার কদমে হাজারো জিব্রাইল, হাজারো গাউছে পাক কুরবান!!! (সুবহা-নাল্লা-হ্)

সুতরাং এখান থেকে এ মাসআলাটিও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সর্ব সৃষ্টিতে নবিজি হাযির ও নাজির বরং তা নয়, সকল সৃষ্টিই হুযুর পাকের নিকট হাযির রয়েছে। সে ক্ষমতা তাঁকে আল্লাহ পাক দান করেছেন।

আমাদের নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল নবি (আলাইহিমুস সালাম) থেকে উত্তম

অন্যান্য সকল নবীগণকে নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায় বা ভূ-খন্ডের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে কিন্তু হুযুর পাক নিজেই ইরশাদ করেন- ارسلت الي الخلق كافة (আমাকে আল্লাহ’র সকল সৃষ্টির জন্য প্রেরণ করা হয়েছে)। (মুসলিম)

তাঁকে সকল সৃষ্টি এমনকি সকল নবিগণের উপরও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। যেমন- দারেমি, আবু ই‘য়ালা, তাবারানি এবং ইমাম বায়হাক্বি বর্ণনা করেন যে-

ان الله تعالي فضل محمدا صلي الله عليه وسلم علي الانسان وعلي اهل السماء

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পাক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সকল নবিগণের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং আসমানবাসীর উপরও।

হুযুর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) হতেও উত্তম

হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম রব্বে ইজ্জতের দরবারে যা আরজ করেছেন কিংবা প্রার্থনা করেছেন, আমাদের নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি সওয়া সাল্লাম-কে এগুলো এমনিতেই আল্লাহ্ পাক দান করেছেন। যেমন-

* হযরত খলিলুল্লাহ আল্লাহ’র দরবারে ফরিয়াদ করেছেন, لاتخزني يوم يبعثون (হে আল্লাহ! পুনরুত্থান দিবসে তুমি আমায় লাঞ্চিত করো না)। (সূরা আশ-শু‘য়ারা : ৮৭)

আর এদিকে নবি পাক সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক নিজেই বলেছেন, يوم لاتخزي الله النبي والذين امنوا معه (ঐদিন আল্লাহ নবিজিকে এবং তাঁর সাথী ঈমানদারগণকে লাঞ্চিত করবেন না)। (সূরা আত-তাহরীম : ৮)

* ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এসেছে, ذاهب الي ربي سيهدين (ইব্রাহিম নবি বললেন, আমি আমার রবের দিকে চললাম, তিনি আমাকে হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখবেন)। (সূরা আস-সাফ্ফাত : ৯৯)

আর এদিকে নবিজিকে আল্লাহ নিজেই দাওয়াত করে নিয়েছেন প্রিয়তম বান্দাহ্ হিসেবে। ইরশাদ করেছেন, سبحان الذي اسري بعبده (আমার প্রিয়তম বান্দাহ্কে আমি ভ্রমণ করিয়েছি)। (সূরা বনী ইসরাইল : ১)

* ইব্রাহিম নবি বললেন, سيهدين (অতএব তিনিই আমাকে হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখবেন)। (সূরা আয-যুখরুফ : ২৭)

এদিকে হাবিব পাককে নিজে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ويهديك صراطا مستقيما (আর হাবিব! আপনাকে আমি প্রতিষ্ঠিত করি হেদায়াতের উপর)। (সূরা আল-ফাত্হ : ২)

* ইব্রাহিম নবির নিকট যে সকল ফেরেশতারা আসে তাঁরা তাঁর সম্মানিত মেহমান। যেমন- ইরশাদ হয়েছে, هل اتاك حديث ضيف ايراهيم المكرمين (আপনার নিকট কি ইব্রাহিমের সম্মানিত মেহমানের বৃত্তান্ত আসেনি?)। (সূরা আয-যারিয়াত : ২৪)

আর হাবিব পাকের নিকট আসা ফেরেশতারা হলেন তাঁর খাদেম বা সৈন্য-সামন্ত। যেমন- আল্লাহ’র বাণী, وايده بجنود لم تروها (আর তাঁর সাহায্যে এমন সৈন্য নিয়োজিত করেছি, যাদের তোমরা দেখনি।) (সূরা আত-তাওবাহ্ : ৪০)

অন্যত্র এসেছে, يمددكم ربكم بخمسة الاف من الملائكة مسومين (তোমাদের রব চিহ্নিত ঘোড়ার উপর পাঁচ হাজার ফেরেশতা নিয়োজিত করেছেন তোমাদের সাহায্য করতে)। (সূরা আলে ইমরান : ১২৫)

অতত্রব প্রমাণিত হলো যে, হুযুর পুর নুর সকল নবিগণ হতে এমনকি ইব্রাহিম নবি হতেও শ্রেষ্ঠ।

একটি সন্দেহ ও এর অপনোদন

এখানে একটি সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম হতে শ্রেষ্ঠ এমনকি সকল নবিগণ হতেও। কিন্তু এ শ্রেষ্ঠত্বের জন্য সর্ব দিক থেকেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্বতা থাকা আবশ্যক। হযরত ইব্রাহিমতো স্বীয় জান এবং স্বীয় সন্তান রবের রাহে কুরবানি করেছেন, তাই আমাদের নবিজিও কি এমনটি করেছেন? আর না করলে এদিক দিয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব কি করে হয়?

এর জবাব হলো এই যে, হ্যাঁ। আমাদের নবি পাকও স্বীয় জান ও আপন সন্তানকে কুরবানি করেছেন। আর তা হযরত ইব্রাহিমের থেকেও উত্তম পন্থায়। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়াশ রাখছি।

হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্বীয় জানের কুরবানি

তবকাতু ইবনি সা‘দ-এ বর্ণিত হয়েছে যে, খায়বর যুদ্ধের সময় যয়নব বিনতে হারেসা নামি জনৈকা ইহুদি রমনী বকরির ভূনা গোশতে বিষ মিশ্রিত করে হুযুর পাকের খেদমতে পাঠিয়ে দেয়। গায়বের খবরদাতা নবি এর থেকে কিছু খেয়েও নিলেন। স্বয়ং ভূনা গোশত তাঁকে জানিয়ে দেয় যে, আমি বিষ মিশ্রিত গোশত। তাঁর সাথে তাঁরই প্রিয় সাহাবি হযরত বিশর ইবনু বারাও ওই গোশত খেয়ে ফেলেন। আর ঐ বিষক্রিয়ায় তিনি তখনই শাহাদাত বরণ করেন। আর তখন নবি পাক ইহুদি মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এরূপ করেছ কেন? উত্তরে মহিলা বলল, আমি জানতে চেয়েছি, আপনি নবি না বাদশা! যদি নবি হন তবে এই বিষ আপনার কোন ক্ষতি করবে না, আর যদি না হন আপনার হাত থেকে মানুষজন স্বস্তি পাবে। যাহোক, ঐ ইহুদি মহিলাকে তাঁর নির্দেশে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

আল্লামা যারকানি এই বিষয়ে উল্লেখ করেন যে, “নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলো, আমাদের প্রিয় নবি শহিদি ওফাত লাভ করেছেন। কেননা তিনি খায়বরের দিন এমন তীব্র বিষ মিশ্রিত বকরির গোশতের কিছু খেয়ে ছিলেন, যে বিষের প্রতিক্রিয়ায় মানুষের ততক্ষনাৎ মৃত্যু হয়। যে ভাবে সে বিষক্রিয়ায় বিশর ইবনু বারা সেই মূহুর্তেই প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন। আর হুযুর পাকের বেঁচে থাকা (অর্থাৎ তখনই বিষ ক্রিয়ায় আক্রান্ত না হওয়া) তাঁর অন্যতম মু‘জেজা ছিল। কিন্তু সেই বিষ তাঁকে প্রায়শঃ যন্ত্রণা দিতে থাকত। এমনকি শেষ পর্যন্ত এরই প্রভাবে তাঁর ওফাত সংঘটিত হয়।

সুতরাং সুস্পষ্ট হলো হুযুর পাকের জানের কুরবানি হযরত ইব্রাহিম থেকেও উত্তম ছিল। কেননা হযরত ইব্রাহিম কুরবানির পরেও জীবিত ছিলেন আর নবি পাক কুরবানি করেছেন এবং জাহেরিভাবে ওফাতও বরণ করেছেন। নবিজি আরও ইরশাদ করেন, আল্লাহ’র রাহে আমি যতটা যাতনাগ্রস্থ হয়েছি, আর কোন নবি তেমটি হননি।

হুযুর পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্বীয় সন্তানকে কুরবানি প্রদান

হযরত আল্লামা জামি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, একদিন সরকারে দু’আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ইমাম হুসাইনকে ডানে এবং স্বীয় সাহেবজাদা হযরত ইব্রাহিমকে বামে বসিয়ে ছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত জিব্রাইল উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আল্লাহ্ তা‘আলা এ দু’জন আপনার কাছে এক সঙ্গে রাখতে দিবেন না, ওনাদের মধ্যে একজনকে ফিরিয়ে নিবেন। অতএব এ দ’ুজনের মধ্যে আপনি যাকে ইচ্ছা পছন্দ করুন। হুযুর ফরমালেন, যদি হুসাইনকে নিয়ে যায় তাহলে এর বিরহে ফাতেমা ও আলি উভয়েরই কষ্ট হবে এবং আমার মনটাও ক্ষুন্ন হবে। আর যদি ইব্রাহিমের ওফাত হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি দুঃখ একমাত্র আমিই পাব। এজন্য নিজে দুঃখ পাওয়াটাই আমি পছন্দ করি। এ ঘটনার তিনদিন পর হযরত ইব্রাহিম ইন্তেকাল করেন।

এরপর থেকে যখনই ইমাম হুসাইন হুযুর পাকের সমীপে আসতেন, হুযুরপাক তাঁকে মোবারকবাদ দিতেন ও কপালে চুমু খেতেন এবং উপস্থিত লোকদেরকে সম্বোধন করে বলতেন, আমি হুসাইন এর জন্য আপন সন্তান ইব্রাহিমকে কুরবানি দিয়েছি। (শাওয়াহেদুন নবুওয়াত)

এদিকে ফোরাতকূলে ইমাম হুসাইনও কুরবানি হলেন নানাজির আদর্শের জন্য-দ্বিন ইসলামের জন্য। নবিজি এ কুরবানির কথা জেনেও তাঁর হেফাজতের জন্য দোয়া করলেন না, শুধু দোয়া করলেন যেন আল্লাহ ধৈর্য্য ধারনের তৌফিক দান করেন। আল্লাহু আকবার! কতইনা উত্তম কুরবানি।

শুধুই কি তাই? একে একে সকল সাহেবজাদাগণ যুবক পুরুষ হওয়ার আগেই ইন্তেকাল করলেন। এর বিনিময়ে উম্মতের জন্য যাবতীয় কল্যাণ-বেহেশত-কাউছার গ্রহণ করে নিলেন। সূরা কাউসার এরই প্রমাণ বহন করে।

অতএব উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সুস্পষ্ট হল যে, হুজুর পাকের কুরবানী আল্লাহ’র সকল সৃষ্টির কুরবানী হতে উত্তম।

উম্মতের প্রতি সরকারে দু’আলমের ইহ্সান

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহু হতে বর্ণিত যে-

ان رسول الله صلي الله عليه وسلم كان اذا اراد ان يضحي اشتري كبشين عظيمين سمينين اقرنين املحين موجوئين فذبح احدهما عن امته لمن شهد لله بالتوحيد وشهد لله بالتوحيد وشهد له بالبلاغ وذبح الاخر عن محمد وعن ال محمد وعن ال محمد صلي الله عليه وسلم

অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কুরবানি করতে ইচ্ছা করতেন, দু’টো মোটাতাজা, গোশতওয়ালা, শিংবিশিষ্ট, চিত্রা রংয়ের খাসিকৃত দুম্বা ক্রয় করতেন। অতঃপর এর একটি স্বীয় উম্মতের যারা আল্লাহ’র তাওহিদ এবং তাঁর নবুয়্যাত প্রচারের সাক্ষী দেয় তাঁদের পক্ষ হতে এবং অপরটি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের পক্ষ হতে কুরবানি করতেন। (ইবনু মাজাহ)

ফায়েদা: আমাদের আক্বা-মাওলা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিশাল দয়াকে লক্ষ্য করুন। তিনি স্বয়ং এ ভাগ্যবান উম্মতের পক্ষ হতে কুরবানি করেছেন এবং সে স্থানেও উম্মতকে স্বরণ করেছেন। এজন্য যে সকল মুসলমানদের সামর্থ্য হয় যে, হুযুর পাকের নামে কুরবানি করবে তাঁরা কেমন সৌভাগ্যবান। (বাহারে শরিয়ত ও কানুনে শরিয়ত)
হাদিস শরিফের আলোকে কুরবানির ফযিলত

(১) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, ইয়াওমুন নাহর তথা যুলহজ্জ্বের দশম তারিখে কুরবানি করার চেয়ে আদম সন্তানের অন্য কোন আমল আল্লাহ’র নিকট অধিক প্রিয় নয়। আর কিয়ামতের দিন ঐ পশুটি নিজের শিং, লোম ও ক্ষুরসহ হাযির হবে এবং কুরবানীর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহ’র নিকট তা কবুল হয়ে যায়। কাজেই তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানি কর। (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ)

(২) সাহাবায়ে কেরাম হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই কুরবানির হুকুম কী? হুযুর পাক ইরশাদ করলেন, এটি তোমাদের পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নাত। তাঁরা আবার আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আমাদের জন্য এতে কী ছাওয়াব রয়েছে? ইরশাদ করলেন, এতে (কুরবানির পশুটির) প্রত্যেক পশমের সমান নেকি রয়েছে। আবার জিজ্ঞেস করলেন, দুম্বা বা ভেড়ার পশমের হুকুম কী? ফরমালেন, দুম্বা বা ভেড়ার প্রত্যেক পশমের পরিবর্তেও নেকি রয়েছে। (ইবনু মাজাহ)

(৩) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা ‘আনহু বলেন, হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা শরিফে ১০ বছর ছিলেন এবং প্রত্যেক বছরই তিনি কুরবানি করেছেন। (মিশকাত ও তিরমিযি)

(৪) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি খুশিমনে ছাওয়াবের প্রত্যাশায় কুরবানি করবে, তা জাহান্নামের আগুন থেকে তাঁকে আড়াল করে দিবে।

(৫) রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সামর্থ থাকার পরও কুরবানি করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। (ইবনু মাজাহ)

(৬) হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ফরমান, যে পয়সা ঈদের দিন কুরবানি করতে খরচ করা হয়, এর থেকে বেশি প্রিয় অন্য কোন পয়সা নেই। (তাবারানি)

(৭) হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘য়ালা’র ইবাদতের জন্য যুলহজ্জ্বের দশম ভাগের অর্থাৎ ঈদের পূর্বের দিনের চেয়ে উত্তম কোন সময় নেই। এর মধ্যে একদিন রোযা রাখা এক বছরের রোযার সমান, এক রাতে ইবাদত করা ক্বদরের রাত্রিতে ইবাদত করার সমান। (তিরমিযি, ইবনু মাজাহ)

(৮) যখন তোমরা কুরবানির ঈদের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের মধ্যে কেউ কুরবানি করতে চায়, তবে সে যেন চুল কাটা ও নখ কাটা হতে বিরত থাকে। (মুসলিম)

(৯) হযরত বুরাইদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না, আবার কুরবানি ঈদের দিন ঈদগাহে নামায পড়ার পূর্বে কিছু খেতেন না। (তিরমিযি, ইবনু মাজাহ)

(১০) হযরত ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে কুরবানি করতে নিষেধ করেছেন। (বাহারে শরিয়ত)

(১১) ইমাম মুসলিম উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণনা করেন, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিলেন যে, শিং ওয়ালা একটি ভেড়া নিয়ে আস। যা কালো অবস্থায় হাটবে, কালো অবস্থায়ই বসবে এবং কালো অবস্থায় দেখবে (অর্থাৎ এর পা, পেট এবং চোখ কালো হবে)। এমনকি তা কুরবানির জন্য উপস্থিত করা হল। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরমান, হে আয়েশা! ছুরি নিয়ে আস এবং ছুরিটি পাথরে ধার দিয়ে নাও। অতঃপর হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছুরি নিলেন ও দুম্বাটিকে শুয়িয়ে দিলেন এবং তা জবাই করলেন। এরপর দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আপনি এটিকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ থেকে এবং তার পরিবারবর্গ ও উম্মতের পক্ষ হতে কবুল করুন।

যাদের উপর কুরবানি করা ওয়াজিব এবং যাদের উপর ওয়াজিব নয়

কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। তা হলো-

(১) মুসলিম হওয়া; সুতরাং অমুসলিমদের উপর তা ওয়াজিব নয়।

(২) মুকিম হওয়া; কাজেই মুসাফিরদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়।

(৩) ধনী হওয়া অর্থাৎ নিসাব পরিামাণ সম্পদের মালিক হওয়া। এখানে এর অর্থ হলো, যার উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়, এটা উদ্দেশ্য নয় যে, যার উপর যাকাত ফরজ হয় (অর্থাৎ মাল এক বছর মালিকানায় থাকা এবং শর্ত নয়, বরং ঈদের দিন যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকে তবেই তার উপর কুরবানি ওয়াজিব)। যে ব্যক্তি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের মালিক কিংবা মৌলিক প্রয়োজন ছাড়া যে ব্যক্তি এ পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, যার মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণের সমান, তবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব।


Comments


  • (৪) বালেগ হওয়া; সুতরাং নাবালেগ এর উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়, তবে করলে ভাল। যদি কেউ বালেগ ছেলে অথবা স্ত্রীর পক্ষ হতে কুরবানি করতে চায় তবে তাদের থেকে অনুমতি নেয়া শর্ত। অনুমতি ব্যতীত ওয়াজিব আদায় হবে না। পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। সম্পদশালী মহিলাদের উপরও কুরবানি ওয়াজিব হয়, যেমনটি পুরুষের উপর হয়।

    (৫) সময় পাওয়া আবশ্যক অর্থাৎ দশ যুলহজ্জ্ব সুবহে সাদিকের পর হতে বার যুলহজ্জ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনদিন দু’রাত। এ দিনসমূহকে কুরবানির দিন বা আইয়ামুন নাহর বলা হয়।

    কিছু জরুরি মাসআলা

    মাসআলা-১: শহরে কুরবানি করার বিধান হলো, ঈদের নামাযের পরেই তা করতে হবে নামাযের পূর্বে হবে না। আর গ্রামে কুরবানির জন্য এই শর্ত নেই। গ্রামে সুবহে সাদিকের পর থেকেই কুরবানি হয়। কেননা গ্রামে ঈদের নামায নেই।

    উল্লেখ্য যে, বর্তমান গ্রামগুলো শহরের হুকুমের আওতাভূক্ত।

    মাসআলা-২: নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে কুরবানি হবে না। যদি কেউ করে ফেলে কুরবানি হয়নি, আবার কুরবানি করবে। আর সময়ের পরে কুরবানি করলেও কুরবানি হবে না। তবে তখন কুরবানির পশুর মূল্যের সমান সদকা করবে।

    মাসআলা-৩: কুরবানির সময় কুরবানি করাই আবশ্যক, অন্যকিছু এর স্থলাভিষিক্ত হবে না। যেমন, কুরবানির পরিবর্তে লাখ টাকা সদকা করে দেয়া প্রভৃতি।

    মাসআলা-৪: শর্তগুলো নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ণ অংশেই পাওয়া জরুরি নয় বরং কুরবানির জন্য যে সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছে ঐ সময়ের যে কোন অংশে শর্তগুলো পাওয়া যাওয়াই কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যেমন, কোন ব্যাক্তি কুরবানির নির্দিষ্ট সময়ের প্রথম দিকে দরিদ্র ছিল এবং কুরবানির দিনসমূহের পরবর্তি যে কোন সময়ে ধনী হয়ে গেল, অনুরূপ মুসাফির মুকিম হয়ে গেল, অমুসলিম মুসলিম হয়ে গেল কিংবা নাবালেগ বালেগ হয়ে গেল, তবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হয়ে যাবে।

    কুরবানির পশু এবং এদের বয়স

    কুরবানির পশু তিন প্রকার। যথাঃ উট, গরু ও ছাগল। আর এগুলোর যত প্রজাতী রয়েছে সবগুলোও এ তিন প্রকারের মধ্যে শামিল। নর হউক বা মাদী কিংবা খাসি সবগুলোর হুকুম একই। অর্থাৎ সবগুলোর দ্বারাই কুরবানি শুদ্ধ। এমনকি মহিষ ও বলদ গরুর মধ্যে শামিল, আর ভেড়া এবং দুম্বা ছাগলের মধ্যে শামিল। (বাহারে শরিয়ত)

    পশুর বয়স:

    কুরবানির পশুর বয়স এমন হওয়া উচিত-

    * উট, পাঁচ বছর;

    * গরু বা গরু জাতীয় পশু, দুই বছর;

    * ছাগল বা এ জাতীয় পশু, এক বছর।

    এর থেকে যদি কম বয়স্ক হয় তাহলে কুরবানি জায়েয হবে না, বেশি হলে জায়েয বরং উত্তম। আবার যদি দুম্বা অথবা ভেড়ার ছয়মাসের বাচ্চা দূর থেকে দেখতে এক বছরের বাচ্চার মতো মনে হয়, তবে তা দ্বারাও কুরবানি জায়েয।

    পশুতে যে সকল ত্রুটি থাকলে এর দ্বারা কুরবানি করা জায়েয নয়

    (১) অন্ধ হলে,

    (২) কানা বা এক চক্ষু বিশিষ্ট হলে অর্থাৎ যার কানা হওয়া স্পষ্ট,

    (৩) তিন ভাগের একভাগ হতে বেশি দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে গেলে,

    (৪) বেশি ক্ষীণ হলে, অর্থাৎ এমন কম জোর হওয়া যে, এর হাড়ের মাঝে মগজ না থাকা,

    (৫) এমন লেংড়া হওয়া, যাতে কুরবানির স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে না পারে,

    (৬) অসুস্থ হওয়া, যা প্রকাশ্য হয়,

    (৭) কান বা লেজ এর এক তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশি কাটা হলে,

    (৮) জন্ম হতেই কান না থাকলে,

    (৯) এক কান থাকলে,

    (১০) দাঁত না থাকলে,

    (১১) স্তন কাটা বা শুকনা হলে,

    (১২) নাক কাটা হলে,

    (১৩) ঔষধের মাধ্যমে স্তন শুকিয়ে গেলে,

    (১৪) হিজরা পশু যেগুলোর মাঝে নর ও মাদী দুটোই আলামত রয়েছে,

    (১৫) ঐ পশু যা শুধু নাপাকি, ময়লা-আবর্জনা ভক্ষন করে,

    (১৬) এক পা কেটে নেওয়া হলে,

    (১৭) পশু এমন পাগল হলে, যা ঘাস পানি মাঠে চড়ে না খেতে পারে এবং

    (১৮) শিং যদি গোড়া থেকে উঠে যায়, তবে এধরনের পশুদ্বারা কুরবানি জায়েজ হবে না।

    পশুতে যে সকল ত্র“টি থাকলেও এর দ্বারা কুরবানি করা জায়েয

    (১) চক্ষু টেঁরা হলে,

    (২) দৃষ্টি শক্তি তিন ভাগের এক ভাগ অথবা এর চেয়ে কম নষ্ট হলে,

    (৩) যার মধ্যে সামান্য পাগলামি রয়েছে অর্থাৎ পশুটি পাগল হলেও মাঠে চড়ে ঘাস খেতে পারে,

    (৪) যে পশুর খুঁজলি রয়েছে, তবে মোটা তাজা,

    (৫) লেজ অথবা কান এক তৃতীয়াংশ অথবা এর থেকে কম কাটা থাকলে বা কান ছোট হলে,

    (৬) পশুটি খাসি করা হলে, বরং এর দ্বারা কুরবানি করা উত্তম, (ফতুয়ায়ে রেজভিয়া, বাহারে শরিয়ত, ফতুয়ায়ে শামি, বাহরুর রায়েক)

    (৭) ভেড়া অথবা দুম্বার পশম কাটা থাকলে,

    (৮) শরীরে দাগ থাকলে,

    (৯) যে পশুর দুধ বের হয় না, তবে স্তন শুকনা দেখায় না,

    (১০) গাভী বা উটনীর শুধু একটি মাত্র ওলান যদি ঔষধের মাধ্যমে শুকিয়ে যায়,

    (১১) যে লেংড়া পশু চলার সময় লেংড়া পায়ের সাহায্য নিয়ে থাকে,

    (১২) যে পশুর শিং গোড়া থেকে ভাংগেনি, তবে এ ধরনের পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়েয।

    কুরবানির পশুতে অংশীদারিত্ব হওয়ার মাসআলা

    * গরু এবং উটের মধ্যে সাত ব্যক্তি শরিক হতে পারবে, কিন্তু অংশীদারদের মধ্যে যদি কারো সাত ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম হয়, তবে কারো কুরবানি হবে না। তবে হ্যাঁ, সাতের এক অংশের চেয়ে বেশি হলে সমস্যা নেই। যেমন, গরু অথবা উটে ছয় বা পাঁচ জনের পক্ষ হতে কুরবানি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সকলের অংশ সমান হওয়া আবশ্যক নয়। তবে তা আবশ্যক যে, কারো অংশ যেন সাতের এক অংশের কম না হয়।

    * গরু বা উটের শরিকদারদের মধ্যে যদি কোন একজনও কাফের বা বে-দ্বিন অথবা বদ মাযহাবি কিংবা তাদের মধ্যে কারো উদ্দেশ্য যদি শুধু এমন হয় যে, গোশত খাবে তবে কারো কুরবানি হবে না।

    * কুরবানির সকল অংশীদারদের নিয়্যত আল্লাহর নৈকট্য অর্জন হতে হবে। অর্থাৎ কারো উদ্দেশ্য যেন গোশত নেয়া না হয়। কিন্তু এটা আবশ্যক নয় যে, ঐ নিয়্যত এক রকমের হবে। যেমন, কুরবানির সাথে আক্বিক্বারও অংশীদার হতে পারবে। কেননা আক্বিক্বা’র নিয়্যতও নৈকট্য অর্জন করা।

    * অংশীদারদের সাথে কুরবানি হলে আবশ্যক যে, গোশত ওজন করে বন্টন করা, অনুমানের ভিত্তিতে বণ্টন করা নয়। কেননা হতে পারে কারো বেশি হয়ে যাবে আবার কারো কম হবে; এটা নাজায়েয। কেউ যদি মনে করে, কম হউক বা বেশি হউক একে অন্যকে মাফ করে দিবে; এরূপ শুদ্ধ নয়। তবে সকল অংশীদার যদি একজনকে মালিক বানিয়ে দেয় যে, যাকে চায় সে গোশত দিবে, যাকে চায় না দিবে এবং তার না দেয়ার জন্য কোন অংশীদার অসন্তুষ্ট হবে না; তবে এক্ষেত্রে তা জায়েয হবে এবং তখন ওজন করাও আবশ্যক নয়। (ওয়াকারুল ফাতাওয়া, চতুর্থ খন্ড)

    কুরবানির অন্যান্য মাসআলাসমূহ

    (১) কোন ব্যক্তি দরিদ্র ছিল আর এঅবস্থায় কুরবানি করে ফেলেছে, কুরবানি করার পর কুরবানির সময় বাকী থাকতে সে ধনি হয়ে গেল, তবে তার জন্য আবার কুরবানি করতে হবে। কেননা প্রথমে যা করেছে তা ওয়াজিব ছিল না। (আলমগিরি)

    (২) কুরবানির সময় কুরবানি করাই আবশ্যক, অন্য কোন বিষয় এর স্থলাভিষিক্ত হবে না। যেমন, কুরবানি করার পরিবর্তে কোন বকরি বা এর মূল্য সদকা দেওয়া যথেষ্ট নয়। কুরবানির মধ্যে অন্যকে স্থলাভিষিক্ত করা যায়। অর্থাৎ নিজে কুরবানি করা জরুরি নয়, অন্যকাউকে অনুমতি দিলে সে যদি করে দেয়, তবে কুরবানি হয়ে যাবে। (বাহারে শরিয়ত)

    (৩) আইয়ামুন নাহর তথা কুরবানির দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে এবং যার উপর কুরবানি ওয়াজিব ছিল সে কুরবানি করে নাই, তখন কুরবানি বাদ হয়ে গেছে এখন করলে হবে না। তবে কুরবানির পশু কিনে থাকলে তা সদকা করে দিবে অথবা না কিনলে এর সমপরিমাণ মূল্য সদকা করে দিবে।

    (৪) কুরবানির দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে এবং কুরবানিও করে নাই, আবার পশু অথবা এর মূল্যও সদকা করে নাই, এঅবস্থায় দ্বিতীয় কুরবানির ঈদ চলে এসছে, এখন সে ব্যক্তি পূর্বোক্ত বছরের কুরবানি কাযা করলে হবে না। বরং এখনো ঐ হুকুমই যে, পশু অথবা এর মূল্য সদকা করবে। (আলমগিরি)

    (৫) যে পশু কুরবানি ওয়াজিব ছিল, কুরবানির সময় কুরবানি না করে কুরবানির দিন অতিবাহিত হওয়ার পর এটাকে বেঁচে দিল, তবে এর মূল্যটা সদকা করা ওয়াজিব। (আলমগিরি)

    (৬) কুরবানি করার সময় পশুর লাফ-ঝাঁপ দেয়ার কারণে কিংবা অন্য যে কারনেই পশুতে ত্র“টি সৃষ্টি হয়ে থাকলে এতে কুরবানি হয়ে যাবে। (ফাতুয়ায়ে শামি)

    (৭) আইয়ামুন নাহরের দুই রাতেই কুরবানি হবে। তবে রাত্রে জবাই করা মাকরূহ। (আলমগিরী)

    (৮) কুরবানির পশু মুসলমানদের দ্বারা জবাই করানো চাই। যদি কোন অগ্নি উপাসক, কাফের, মুশরিক, হিন্দু, বে-দ্বিন, অথবা মুরতাদ (ধর্ম ত্যাগি) দ্বারা কুরবানির পশুটি জবাই করা হয়, তবে কুরবানি হবে না এবং গোশত খাওয়াও হারাম হবে। (বাহারে শরিয়ত)

    (৯) কুরবানির গোশত কাফের, হিন্দু, মোরতাদ, বে-দ্বিন বা এ জাতীয় কাউকে দেওয়া যাবে না। (বাহারে শরিয়ত)

    (১০) কুরবানির চামড়া অথবা গোশত কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না।

    (১১) অন্যকাউকে দিয়ে পশু জবাই করালো এবং নিজের হাতও ছুরির উপর রাখল, যেন দু‘জন মিলেই জবাই করল। এঅবস্থায় দু’জনকেই ‘বিসমিল্লাহ’ বলা ওয়াজিব। একজনও যদি ইচ্ছা করে ছেড়ে দেয় এই ভেবে যে, দ্বিতীয় ব্যক্তিতো বলেই দিয়েছে আমার বলার প্রয়োজন কি, তবে পশু হারাম হবে। (দুররুল মুখতার)

    (১২) কুরবানি করবে তো মুস্তাহাব এটা যে, যুলহজ্জ্বের প্রথম থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত মাথা না মুন্ডানো এবং নখ না কাটা। (রদ্দুল মুহতার)

    (১৩) মুস্তাহাব এই যে, কুরবানির পশু মোটা-তাজা, সুন্দর এবং বড় হবে আর ছাগল থেকে যদি হয় তবে উত্তম হলো শিংওয়ালা এবং চিত্রা রংয়ের হওয়া। হাদিস শরিফে রয়েছে, হুযুর নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরনের ভেড়া বা দুম্বা কুরবানি করেছেন। (আলমগিরী)

    (১৪) কুরবানির পশুর মাঝে আক্বিক্বার অংশিদারও হতে পারবে।

    পশু কেনার পর মারা গেলে বা হারিয়ে গেলে এর বিধান

    (১৫) কুরবানির পশু কেনার পর মারা গেছে, তখন ধনী ব্যক্তির উপর আবশ্যক যে অন্য আরেকটি পশু কুরবানি করবে। আর দরিদ্র ব্যক্তির উপর তা ওয়াজিব নয়। (শামি)

    (১৬) যদি কুরবানির পশু হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায় এবং এর স্থানে অন্য পশু ক্রয় করে ফেলেছে, এমতাবস্থায় হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হওয়া পশুটি আবার ফিরে পেয়েছে, তখন ধনী ব্যক্তির এখতিয়ার রয়েছে যে দুটোর মধ্যে যে কোন একটি কুরবানি করবে। আর দরিদ্র ব্যক্তি দুটোই কুরবানি করতে হবে। তবে ধনী ব্যক্তি যদি দ্বিতীয় পশুটিকে কুরবানি করে এবং এর মূল্য প্রথমটি হতে কম হয়, তবে যে মূল্যটা প্রথমটি হতে কম হয়েছে তা সদকা করে দিতে হবে। কিন্তু প্রথমটিও কুরবানি করে দিলে আর সদকা ওয়াজিব থাকবে না। (শামি)

    পশুর পেটে বাচ্চা পাওয়া গেলে এর বিধান

    (১৭) কুরবানি করা হয়েছে এবং কুরবানিকৃত পশুটির পেটে জীবিত বাচ্চা পাওয়া গেছে, তখন বাচ্চাটি সদকা করে দিবে অথবা এটাকে জবাই করে দেবে। আর যদি বাচ্চাটি মৃত পাওয়া যায়, তবে এটা ফেলে দিবে, কেননা তা মৃত; কুরবানি হয়ে যাবে। (বাহারে শরিয়ত)

    পশু কেনার পর শরিকদারের মৃত্যু হলে এর বিধান

    (১৮) কয়েক জন অংশিদার মিলে কুরবানির জন্য একটি গরু ক্রয় করল, অতঃপর এদের মধ্যে একজন শরিকদার মৃত্যু বরণ করল, তখন মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ যদি অন্যান্য অংশিদারদেরকে বলে দেয় যে, তোমরা তা নিজেদের পক্ষ হতে এবং তার (মৃত্য ব্যক্তির) পক্ষ হতে কুরবানি করে দাও এবং তারা করেও দিল তবে তা জায়েজ হবে। আর যদি ওয়ারিশদের বিনাঅনুমতিতে কুরবানি করে দেয়, তবে কারো কুরবানি হবে না। (হেদায়া)

    মান্নতের কুরবানির বিধান

    (১৯) কুরবানি যদি মান্নতের হয় তবে এর গোশত নিজেও খেতে পারবে না এবং কোন ধনী ব্যক্তিদেরকেও খাওয়াতে পারবে না। বরং তা সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। যদিও মান্নতকারী দরিদ্র হয় তথাপিও নিজে খেতে পারবে না। (বাহারে শরিয়ত)

    (২০) মালিকে নিসাব বা যার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব সে যদি কুরবানি করার জন্য মান্নত করে, তবে তার উপর দুটো কুরবানি করা ওয়াজিব। একটি মান্নতের জন্য, অন্যটি তার উপর যা ওয়াজিব ছিল এজন্য। যতটি মান্নত করা হয়, ততটি কুরবানি করা ওয়াজিব। (শামি)

    কুরবানির জন্য ওসিয়তের বিধান

    (২১) মৃত ব্যক্তির পক্ষ হতে কুরবানি করলে এর গোশত নিজেও খেতে পারবে এবং অন্যদেরকেও খাওয়াতে পারবে। তবে যদি মৃত ব্যক্তি ওসিয়ত করে থাকে যে, আমার পক্ষ হতে কুরবানি করে দিও তখন এ অবস্থায় কুরবানি কারী গোশত খাবে না। বরং সম্পূর্ণ গোশত সদকা করে দিবে। (শামি)

    কুরবানি করার পদ্ধতি

    * কুরবানির পশু উল্লেখিত শর্তগুলো মোতাবেক হবে এবং ঐসকল ত্রুটি হতে মুক্ত হবে, যে কারনে কুরবানি নাজায়েজ হয়।

    * পশু ভাল এবং মোটা-তাজা হবে।

    * কুরবানি করার পূর্বে পশুকে ঘাস-পানি দিবে, যেন ক্ষুদার্ত ও পিপাসার্ত অবস্থায় জবাই করা না হয়।

    * একটি পশুর সামনে অন্যটি জবাই করবে না।

    * প্রথমে ছুরি ধাড়ালো করে নিতে হবে।

    * অতপর পশুটিকে বাম পাশে কেবলা মুখী করে শুইয়ে দিবে এবং নিজের ডান পা পশুটির গলার উপর রেখে তারাতারি জবাই করে দিবে।

    * জবাই করার প্রথমে এ দোয়া পড়ে নিবে-

    اني وجهت وجهي للذي فطر السموات والارض حنيفا وما انا من المشركين . ان صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين . لاشريك له وبذالك امرت وانا من المسلمين

    উচ্চারণ: ইন্-নী ওয়াজ্জা‘হ্তু ওযাজ্হিয়া লিল্লাযী ফাতারাস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল র্আদ্বা ‘হানীফাও্ ওয়ামা আনা- মিনাল্ মুশ্রিকীন। ইন্-না ছলা-তী ওয়া নুসুকী ওয়া মা‘হ্ইয়া-ইয়া ওয়া মামা-তী লিল্লা-হি রাব্বিল ‘আ-লামীন। লা-শারীকা লাহু ওয়া বিযা-লিকা উর্মিতু ওয়া আনা- মিনাল্ মুসলিমীন।

    * কুরবানি নিজের পক্ষ হতে হলে জবাই করার পর নিমোক্ত এ দোয়াটি পড়বে-

    اللهم تقبل مني كما تقبلت من خليلك ابراهيم عليه السلام وحبيبك سيدنا محمد صلي الله عليه وسلم

    উচ্চারণ: আল্লা-হুম্-মা তাক্বাব্বাল্ মিন্-নী কামা- তাক্বাব্বাল্তা মিন খালীলিকা ইবরা-হীমা ‘আলাইহিস্ সালাম, ওয়া ‘হাবীবিকা সায়্যিদিনা- মু‘হাম্-মাদিন্ ছল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

    * আর যদি অন্যদের পক্ষ হতে জবাই করা হয় তবে مني (মিন্-নী) এর স্থলে من (মিন্) বলে তাদের নাম বলবে।

    * যতক্ষণ পর্যন্ত পশুটি নিরব ও ঠান্ডা না হয়ে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত হাত-পা কাটবে না, চামড়া আলাদা করবে না।

    জবাই সম্পর্কিত কিছু জরুরি মাসআলা

    (১) নিজের কুরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করাই উত্তম। অন্যের দ্বারা জবাই করালেও জায়েয হবে, তবে জবাই করার স্থানে উপস্থিত থাকা উত্তম। (শামি)

    (২) জবাই করার সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলতে ভুলে গেলে পরে পড়ে নিবে।

    (৩) জবাইকারী ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়ানো সুন্নাতে মুয়াক্বাদা। বিনা প্রয়োজনে অন্যদিকে হওয়া মাকরূহ।

    (৪) প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষ, বালেগ-নাবালেগ, সুস্থ-পাগল, পবিত্র বা অপবিত্র সকলের জন্যই জবাই করা জায়েয। তবে শর্ত হলো, জবাই করার শরয়ি পদ্ধতি জানতে হবে এবং জবাই করার সময় বিসমিল্লাহ পড়তে হবে। (মালাবুদ্দামিনহু)

    (৫) শরয়ি নিয়ম অনুযায়ী জন্তু জবাই করার সময় চারটি রগ কাটতে হয়। শ্বাস নালী, খাদ্য নালী এবং ওহার দুই পাশে দু’টি রক্তের মোটা রগসহ কমপক্ষে তিনটি কাটা গেলে খাওয়া হালাল হবে। অথবা উল্লেখিত চার রগের বেশির ভাগ কাটা গেলে জন্তু খাওয়া হালাল হবে অন্যথায় হারাম হবে। (শামি)

    (৬) জবাই করার সময় সম্পূর্ণ গলা কেটে ফেলা মাকরূহ। (ফাতহুল কাদির)

    (৭) কুরবানির জন্তু মেশিন দ্বারা জবাই করা জায়েজ। কিন্তু শর্ত হলো, সুইচ চালু করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে এবং উল্লেখিত রগ সমূহ কাটতে হবে।

    (৮) জবাই করার সময় জন্তুর গলার উপর পা রাখা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

    (৯) বিসমিল্লাহ পড়ার পর জন্তু পালিয়ে গেলে দ্বিতীয়বার জবাই করতে বিসমিল্লাহ পড়া ওয়াজিব।

    কুরবানির গোশত এবং চামড়ার বিধান

    * উত্তম এই যে, গোশত তিন ভাগ করবে। একভাগ ফকির মিসকিনদের জন্য, একভাগ বন্ধু-আত্মীয়-নিকটজনদের জন্য এবং আরেক ভাগ নিজেদের জন্য।

    * গোশত কাফের, মুশরিক, হিন্দু এবং বে-দ্বিন মোরতাদদের দিবে না।

    * গোশত, চামড়া ইত্যাদি কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না।

    * যদি মৃত ব্যক্তির পক্ষ হতে কুরবানি করা হয় তবে এরও একই হুকুম। নিজে খাবে অন্যকেও দিবে। আর যদি মৃত ব্যক্তির ওসিয়ত থাকে যে, তার পক্ষ হতে যেন কুরবানি করে দেওয়া হয় তবে কুরবানিকারী গোশত খাবে না। বরং সম্পূর্ণ গোশত সদকা করে দিতে হবে।

    * কুরবানির চামড়া সদকাও করে দিতে পারবে, আবার নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। যেমন, নামাজি বানিয়ে নিজে ব্যবহার করা জায়েজ, কিন্তু যদি তা বিক্রি করে দেওয়া হয় এর মূল্য সদকা করে দিতে হবে।

    * দ্বিনি মাদ্রাসা এবং মসজিদেও তা দান করা জায়েয। তবে মসজিদের ইমামকে বেতন হিসেবে দেওয়া জায়েজ না।

    * জবাই করার আগে কুরবানির পশুর পশম, দুধ গ্রহণ করা মাকরূহ এবং পশু থেকে কোন উপকার হাসিল করাও মাকরূহ। যেমন, এর উপর সাওয়ার হওয়া বা বোঝা বহন করানো ইত্যাদি।

    * কুরবানির পশু থেকে যদি পশম কাটা হয় তাও সদকা করে দিবে।

    * দ্বিনি মাদ্রাসার গরিব ছাত্রদেরকেই চামড়া সদকা করা উত্তম। কেননা এতে সদকার ছাওয়াবও হলো এবং দ্বিনের খেদমতও হলো, কিন্তু এর মধ্যে অত্যধিক সর্তক হওয়া প্রয়োজন যে, তা যেন সুন্নি-সহিহ মাদ্রাসা হয়। বে-দ্বিন, বদ-মাযহাবকে কখনই দেওয়া যাবে না। এগুলি ইমানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমন যেন না হয়ে যায় যে, তারা কুরবানির চামড়ার সাথে ইমানও ছিনিয়ে নেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

    হালাল পশুর অংঙ্গ-প্রতঙ্গের বিধান

    হারাম বস্তু সমূহ

    (১) প্রবাহিত রক্ত,

    (২) পিত্ত,

    (৩) ঝুঁটি,

    (৪) পেসাবের স্থান,

    (৫) পায়খানার স্থান,

    (৬) অন্ড কোষ এবং

    (৭) মেরু দন্ডের মজ্জা এগুলো সবই হারাম।

    মাকরূহ বস্তু সমূহ

    তিল্লি বা প্লিহা এবং গুরদা হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অপছন্দের ছিল।

    যা খাওয়া সুন্নাত

    কলিজা, বকরির সিনা এবং সামনের দু’পা হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খুবই পছন্দের ছিল।

    আক্বিক্বার মাসাইল

    * আক্বিক্বা করা হানাফি মাযহাব মতে মুস্তাহাব। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সপ্তম দিনে তার নাম রাখবে এবং আক্বিক্বা করবে এর দ্বারা শিশুর বিভিন্ন বালা-মসিবত দূর হয়ে যায়।

    * সপ্তম দিনের পূর্বে নাম রাখাও জায়েজ। আক্বিক্বা সপ্তম দিনে না করতে পারলে পরে যখনই সামর্থ্য হয় করে নেয়া জায়েজ।

    * কুরবানির পশুর জন্য যে শর্ত রয়েছে আক্বিক্বার জন্যও তাই প্রজোয্য। যে পশুর দ্বারা কুরবানি জায়েজ নয়, সে পশু দ্বারা আক্বিক্বাও জায়েজ নয়।

    * আক্বিক্বার গোশত পিতা-মাতাসহ সকলেই খেতে পারবে। এমনকি যার আক্বিক্বা হয় সে যদি খাওয়ার উপযুক্ততা রাখে সে নিজেও খেতে পারবে।

    * আক্বিক্বার চামড়ার হুকুম কুরবানির চামড়ার হুকুমের মতই।

    * মৃত বাচ্চার আক্বিক্বা করা জরুরি নয়। এমনিভাবে জীবিত ভূমিষ্ট হওয়ার পর মারা গেলেও জরুরি নয়।

    * আক্বিক্বার নিয়ম হলো, ছেলে হলে দু’টি বকরি বা দু’টি ভেড়া এবং মেয়ে হলে একটি বকরি বা একটি ভেড়া জবাই করবে এবং শিশুর মাথা মুন্ডন করবে। আর চুলের সম পরিমাণ স্বর্ণ্য বা রৌপ্য দান করবে।

    * আক্বিক্বার জন্তু জবাই করার সময় নিুের দোয়া পড়বে-

    اللهم هذه عقيقة ابن فلان دمها بدمه ولحمها بلحمه وجلدها بجلده وشعرها بشعره اللهم اجعلها فداء لابني من النار

    উচ্চারণ: আল্লা-হুম্-মা হা-যিহী ‘আক্বীক্বাতু ইবনি ফুলা-নিন্ দামুহা- বিদামিহী ওয়া লা‘হ্মুহা- বিলাহ্মিহী ওয়া জিল্দুহা- বিজিল্দিহী ওয়া শা‘রুহা- বিশা‘রিহী। আল্লা-হুম্-মাজ্‘আল্হা- ফিদা—-আল্লিইবনী মিনান্-না–র্-।

    ابن فلان (ইবনি ফুলা-নিন) এর স্থানে ছেলের নাম ও পিতার নাম বলবে অতঃপর নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করবেন। দোয়াটি হল-

    اني وجهت وجهي للذي فطر السموات والارض حنيفا وما انا من المشركين . ان صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين . لاشريك له وبذالك امرت وانا من المسلمين اللهم منك ولك

    উচ্চারণ: ইন্-নী ওয়াজ্জা‘হ্তু ওযাজ্হিয়া লিল্লাযী ফাতারাস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল র্আদ্বা ‘হানীফাও্ ওয়ামা আনা- মিনাল্ মুশ্রিকীন। ইন্-না ছলা-তী ওয়া নুসুকী ওয়া মা‘হ্ইয়া-ইয়া ওয়া মামা-তী লিল্লা-হি রাব্বিল ‘আ-লামীন। লা-শারীকা লাহু ওয়া বিযা-লিকা উর্মিতু ওয়া আনা- মিনাল্ মুসলিমীন। আল্লা-হুম্-মা মিন্কা ওয়া লাক্।

    [সমাপ্ত]

Sign In or Register to comment.
|Donate|Shifakhana|Urdu/Hindi|All Sunni Site|Technology|