ইলমে গায়েব এর সংজ্ঞা
গায়েব হচ্ছে এমন এক আদৃশ্য বস্তু বা বিষয় যা মানুষ চোখ নাক, কান ইত্যাদে দ্বারা উপলব্দি করতে পারে না এবং যা কোন প্রমান ব্যতিরেকে সুস্পষ্টভাবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিধিতেও আসে না । সুতরাং পাঞ্জাবীদের জন্য বোম্বাই গায়েব বা অদৃশ্য নয় । কেননা হয়তো কেউ নিজ চোখে দেখে বা কারো কাছ থেকে শুনে বলেছে যে বোম্বাই একটি শহর । ইহা হচ্ছে ইন্দ্রীয়লব্দ জ্ঞান । অনুরুপ খাদ্য সামগ্রির স্বাদ, সুঘ্রান ইত্যাদি অদৃশ্য নয়, কেননা এগুলো যদিও বা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধি করা যায় । পক্ষান্তরে জিন, ফিরিশতা, বেহেশত-দোযখ এখন আমাদের জন্য গায়েব বা অদৃশ্য । কেননা এ গুলোকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কিংবা বিনা দলিলে বিবেক-বুদ্ধির দ্বারা অনুভব করা যায় না । -সুত্রঃ জা’আল হক ১ম খন্ড-
ইলমে গায়েবের প্রকারভেদ
গায়েব দুই প্রকারঃ (১) এক ধরনের গায়েব আছে, যা যুক্তি প্রমান ভিত্তিক অর্থাৎ প্রমাণাদি দ্বারা অনুভব করা যায় (২) আর এক ধরনের গায়েব আছে, যা দলিলের সাহায্যেও অনুভব করা যায় না । প্রথম প্রকারের গায়েবের উদাহরনঃ বেহেশত-দোজখ এবং আল্লাহ পাকের স্বত্বা ও গুনাবলী । এগুলো সম্পর্কে জগতের সৃষ্ট বস্তু ও কুরআনের আয়াতসমুহ দেখে জ্ঞান লাভ করা যায় । দ্বিতীয় প্রকারের গায়েবের উদাহরনঃ মহাপ্রলয় কখন সংঘঠিত হবে, মানুষ কখন মারা যাবে, স্ত্রীর গর্ভের সন্তান ভাগ্যবান না হতভাগা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান । এ গুলো সম্পর্কে দলিল প্রমানের সাহায্যেও জ্ঞান লাভ করা সম্ভবপর হবে না । এ দ্বিতীয় প্রকারের গায়েবকে মাফাতিহুল গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞান ভাণ্ডার বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং এ ধরনের গায়েব সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
তিনি (আল্লাহ) তাঁর গায়বী বিষয়াদি সম্পর্কে কাহাকেও অবগত করান না, তবে তাঁর মনোনীত রসুলকে ( অদৃশ্য জ্ঞান দান করেন ) যাকে তিনি রসূল রুপে গ্রহন করে নিয়েছেন । )
তাফসীরে বায়যাবীতে بالغيب يؤمنون আয়াতটির ব্যখ্যায় বলা হয়েছে-
গায়েব শব্দ দ্বারা অদৃশ্য বিষয়কে বুঝানো হয়েছে, যা’ ইন্দ্রিয় সমূহের দ্বারা উপলব্দি করা যায় না ও সুস্পষ্টভাবে জ্ঞানানুভূতির আওতায় আসে না ।
তাফসীরে কবীরে সূরা বাকারার শুরুতে ওই একই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে –
সাধারণত তাফসীর কারকগনদের মতে গায়ব হল এমন বিষয় যা ইন্দ্রিয়সমূহ থেকে গোপন থাকে । অতঃপর গায়বকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়ঃ এক প্রকারের গায়ব হচ্ছে – সে সমস্ত অদৃশ্য বিষয়াদি, যেগুলো অবগতির জন্য কোনরুপ দলীল প্রমানের প্রয়োজন হয় না ।
তাফসীরে রুহুল বয়ানে সুরা বাকারার শুরুতে সেই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিপিবদ্ধ আছে-
গায়ব হচ্ছে উহাই যা ইন্দ্রিয় ও জ্ঞানানুভূতি থেকে সম্পূর্ণরুপে এমনভাবে গোপন থাকে যে, কোন উপায়ে প্রথমদিকে স্পষ্টরুপে উপলব্দি করা যায় না । গায়ব দুই প্রকারঃ এক প্রকারের গায়ব হলো যার সম্পর্কে কোন প্রমান নেই । যেমন কুরআনের আয়াত عند مفاتيح الغيب ( আল্লাহর কাছেই রয়েছে গায়েবের চাবি সমূহ ) এ আয়াতে এ ধরনের গায়েবের কথাই বলা হয়েছে । অন্য প্রকারের গায়েব হচ্ছে- যার অবগতির জন্য দলীল প্রমাণ আছে । যেমন- আল্লাহ ও তাঁর গুনাবলী । بالغيب يؤمنون দ্বারা এগুলোর কথাই বলা হয়েছে ।
পাঠকগণের উপকারার্থে নিন্মের বিষয়টি উপস্থাপন করা হলো-
রং চোখ দ্বারা দেখা যায়, নাক দ্বারা ঘ্রান নেয়া হয়, মুখ দ্বারা স্বাদ ও কান দ্বারা স্বর অনুভব করা হয় । সুতরাং মুখ ও কানের জন্য রং হচ্ছে গায়ব অনুরুপ চোখের জন্য ঘ্রান হলো গায়ব । যদি কোন আল্লাহর প্রিয় বান্দা ঘ্রান ও স্বাদেকে বিশেষ আকৃতিতে সচক্ষে অবলোকন করেন, তবে এও আপেক্ষিক ইলমে গায়ব “ইলমে গায়েবে ইজাফি” হিসাবে গন্য হবে । যেমন কিয়ামতের দিন কৃতকর্ম সমূহ বিভিন্ন আকৃতিতে দেখা যাবে । যদি কেও সেগুলোকে ওই আকৃতিতে এখানেই ( এ জগতেই ) দেখে ফেলে, তবে তাও ইলমে গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞানের আওতায় পড়বে ।
হযরত গাউছে পাক রাদিয়াল্লাহু আনহু ফরমানঃ
এ জগতের কোন মাস বা কাল আমার কাছে এসে আমার অনুমতি না নিয়ে অতিবাহিত হয় না ।
এ রকম যা কিছু বর্তমানে মওজুদ বা আস্তিত্তবান না হওয়ার বা অনেক দূরে বা অন্ধকারে থাকার কারনে দেখা যায় না তাও গায়েব হিসাবে গন্য । এ সম্পর্কে জানাটাও অদৃশ্য জ্ঞান । যেমন হুজুর আলাইহি সালাম ভবিষ্যতে উদ্ভাবিত কিংবা আবিস্কৃত হবে- এমন বস্তূ সমূহ দেখেছেন বা হযরত উমর বাদিয়াল্লাহু আনহু মদীনা শরীফ থেকে নেহাওয়ান্দে অবস্থানরত হযরত সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু- কে দেখেছিলেন এবং স্বীয় আওয়াজ তাঁর কাছে পৌছে দিয়ে ছিলেন । অনুরুপ কেউ যদি পাঞ্জাবে বসে মক্কা মুয়াজ্জামা বা অন্যান্য দূরবর্তী দেশসমুহকে হাতের তালু দর্শনের মত স্পষ্টভাবে দেখতে পান, তবে তাও গায়েবের অন্তর্ভূক্ত হবে ।
উপকরন বা যন্ত্রপাতি সাহায্যে যেই সমস্ত অদৃশ্য বস্তুকে অবলোকন করা যায় , উহা ইলমে গায়েবের পর্যায়ে পড়ে না । যেমন যন্ত্রের সাহায্যে কোন মহিলার গর্ভস্থিত সন্তান সম্পর্কে জানা যায় বা টলিফোন ও রেডিও দ্বারা দূরের আওয়াজ শুনা যায় । এ গুলো ইলমে গায়েবের পর্যায়ে পড়ে না । কেননা গায়েবের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, যা কিছু ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায় না, তা’ই গায়েব । আর টেলিফোন ও রেডিও দ্বারা শ্রুত আওয়াজ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায় । যন্ত্রের সাহায্যে গর্ভবতীর শিশুর অবস্থা জানাও ইলমে গায়েব নয় ।
মোট কথা, যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে যদি কোন অদৃশ্য বস্তু প্রকাশিত হয়ে যায় এবং প্রকাশিত হওয়ার পরেই আমরা উহার সম্যক ধারণা লাভে সক্ষম হই, তহলে উহা ইলমে গায়েবের পর্যায়ে পড়ে না । -সুত্রঃ জা’আল হক ১ম খন্ড-
ইলমে গায়েব সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা
ইলমে গায়েব সম্পর্ক আলোচনা করার পূর্বে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয় ভাল-মতে স্মরণ রাখতে পারলে খুবই উপকারে আসবে এবং অধিকাংশ আপত্তি সমূহ আপনা আপনিই মীমাংসা হয়ে যাবে ।
(১) যে কোন বিষয়ের নিছক জ্ঞান দূষণীয় নয় । তবে হ্যাঁ দূষণীয় কোন কিছু করা বা করার উদ্দেশ্য শিখা দূষণীয় । অবশ্য জ্ঞানের কোন কোন বিষয় অন্যান্য বিষয়াদির জ্ঞানের তুলনায় উৎকৃষ্ট যেমন আকাইদ শরীয়তের সুফীবাদ সম্পর্কীত জ্ঞান অন্যান্য শাস্ত্রের জ্ঞান থেকে উৎকৃষ্ট । কিন্তু কোন জ্ঞানই স্বভাবতঃ দূষণীয় নয় । উদাহরণ কুরআনের কোন আয়াত পাঠে অপরাপর আয়াত অপেক্ষা তুলনামুলক ভাবে বেশী ছওয়াব পাওয়া যায় । قُلْ هُوَ اللهُ পাঠে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পাঠের ছওয়াব আছে কিন্তু تَبَّتْ يَدَى এর মধ্যে এ পরিমাণ ছওয়াবি নেই । (তাফসীরে রূহুল বয়ানে وَلَوْكَانَ مِنْ عِنْدِاللهِ لَوَجَدُوْا فِيْهِ اِخْتِلَافًا كَثِيْرًا আয়াত সম্পর্কিত বিবরণ দ্রষ্টব্য) কিন্তু কোন আয়াতই খারাপ নয় ।
কেননা যদি কোন জ্ঞান দূষণীয় হতো তাহলে তা আল্লাহ তা’আলার অপরিসীম জ্ঞানের আওতায় আসত না, কেননা তিনি যাবতীয় দোষত্রুটি থেকে পবিত্র; অনুরূপ আল্লাহর স্বত্ত্বা ও গুণাবলী সম্পর্কিত জ্ঞান ফিরিশতাদেরও ছিল। হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) কে জগতের ভালো-মন্দ সবকিছুর জ্ঞান দান করা হয়েছিল এবং এ জ্ঞানের দ্বারাই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে। এ জ্ঞানের বদৌলতেই তিনি ফিরিশতাদের উস্তাদ সাব্যস্ত হয়েছিলেন । যদি খারাপ বস্তু সমূহের জ্ঞান দূষণীয় হতো তাহলে আদম (আলাইহিস সালাম) কে সে জ্ঞান দান করে কখনও উস্তাদ নিযুক্ত করা হতো না । পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো কুফর ও শিরক । কিন্তু ফিকহ শাস্ত্রবিদগণ বলেন হিংসা-দ্বেষ পরশ্রীকাতরতা ও শত্রুতা সম্পর্কিত জ্ঞান এবং কুফর ও শিরক সম্বলিত শব্দ সমূহ জানা ফরজ বা অত্যাবশ্যকীয় যাতে সেসব নীতি বহির্ভূত কার্য থেকে বিরত থাকা যায় । অনুরূপ যাদু দমন করার জন্য যাদুবিদ্যা শিখাও অত্যাবশ্যক । ফতওয়ে শামীর মুকাদ্দামায় আছেঃ-
وَعِلْمُ الرِّيَاءِ وَعِلْمُ الْحَسَدِ وَالْعُجَبِ وَعِلْمُ الْاَلْفَاظِ الْمُحَرَّمَةِ وَالْمُكَفِّرَةِ وَلَعُمْرِىْ هَذَا مِنْاَهَمِّ الْمُهَمَّاتِ
অর্থাৎ রিয়া, হিংসা-বিদ্বেষ আত্মগরিমা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং হারাম ও কুফর সম্বলিত শব্দ সমূহ শিখা ফরজ (অবশ্য কর্তব্য) । খোদার শপথ ইহা একান্ত প্রয়োজনীয় ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ । শামীর উক্ত মুকাদ্দামায় علم نجوم ورمل (জ্যোতিষ শাস্ত্রের জ্ঞান) এর বর্ণনায় বলা হয়েছে জাহিরাতুন নাজেরা নামক কিতাবে উল্লেখিত আছে যে অমুসলিম অধ্যূষিত অঞ্চলের (যে অঞ্চল শরীয়তের পরিভাষায় দারুল হরব নামে আখ্যায়িত) বিধর্মীদের যাদু প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে যাদুবিদ্যা শিখা ফরজ (অবশ্য কর্তব্য) । ইহয়ায়ে উলুমের প্রথম খণ্ডের ১ম অধ্যয়ের ৩য় পরিচ্ছেদে ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় জ্ঞান সমূহের বর্ণনায় উল্লেখিত আছে যে কোন বিদ্যার দোষ ত্রুটি নিছক বিদ্যার করণে নয় বরং আল্লাহর বান্দাদের ব্যাপারে উক্ত জ্ঞানের প্রয়োগ অনুসারে তিনটি কারণেই দূষণীয় হয়ে থাকে ।
উল্লেখিত বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল যে কোন কিছুর নিছক জ্ঞান দুষণীয় নয় । এতে বিরুদ্ধবাদীদের উত্থাপিত প্রশ্নেরও মীমাংসা হয়ে যায় । প্রশ্নটি হচ্ছে -এ ধারণা পোষণ করা দরকার যে হজুর আলাইহিস সালামের খারাপ বিষয়াদির যেমন চুরি ব্যভিচার যাদু কবিতা ইত্যাদির জ্ঞান ছিল । কেননা এগুলো সম্পর্কে । এজন্যেই তারা শয়তান ও হযরত আযরাইল (আলাইহিস সালাম) এর জ্ঞানের পরিধি হুজুর আলাইহিস সালামমের জ্ঞানের তুলনায় বেশী প্রসারিত বলে দাবী করেন প্রত্যুত্তরে বলতে হয়। আচ্ছা, বলুন, এসব বিষয়ের জ্ঞান খোদার আছে কিনা? তাদের এ বক্তব্যটি অনেকটা অগ্নি উপাসকদের কথার মত। মজুসী, সম্প্রদায়ের লোকেরা বলে যে, আল্লাহ তাআলা নিকৃষ্ট বস্ত সূহের সৃষ্টিকর্তা নন, কেননা খারাপ জিনিস সময়হ সৃষ্টি কতরাটাও দূষণীয় (নাউযুবিল্লাহ) যদি যাদু বিদ্যা দুষণীয় হেতো, তাহলে এর শিক্ষা দেয়ার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে হারুত ও মারুত নামে দু’ফিরিস্তা পৃথিবীতে আবতরণ করলেন কেন? হযরত মুসা আলইহিস সালাম এর সত্যতা যাছাই করে তাঁর উপর ঈমান এনে ছিলেন। দেখুন, যাদু বিদ্যা (এখানে) ঈমানের ওসীলা হয়ে গেল।
২) সমস্ত নবী ও সৃষ্টি কুলের জ্ঞান হুযুর আলাইহিস সালামকে দান করা হয়েছে। মৌলভী কাসেম নানুতবী সাহেবও তাঁর “তাহজিরুন নাস” কিতাবে এটা স্বীকার করেছেন। এর সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি পরে পেশ করা হবে। কোন সৃষ্ট জীবের যে বস্তুর জ্ঞান থাকবে, সে জ্ঞানের অধিকার হুযুর আলাইহিস সালামও নিশ্চয় হবেন। বরং সবাই যে জ্ঞান লাভ করেছেন, উহা হুযুর আলাইহিস সালামের ভাগ বন্টন থেকেই পেয়েছে। শিক্ষক থেকে ছাত্র যে জ্ঞান লাভ করে, সে বিষয়ে শিক্ষকেরও নিশ্চয়ই জ্ঞান থাকতে হবে। নবীগণের মধ্যে হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) ও আছেন। এ জন্যে হযরত আদম (আলাইসি সালাম) ও হযরত খলীলুল্লাহ (আলাইহিস) এর জ্ঞান সম্পর্কেও পরে আলোচনা করা হব।
৩) সমস্ত ঘটানাবলী যা পূর্বে সংঘটিত হয়েছে ও ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে, কুরআন ও লওহ মাহফুজে রক্ষিত আছে। এই লওহ মাহফুজ পর্যন্ত ফিরিশতা ও কোন কোন ওলী ও নবীগণের দৃষ্ট প্রসারিত। এবং সেটা সব সময় হুযূর আলাইহিস সালাম এর সামনে রয়েছে। এজন্য আমি লওহ মাহফযুজ ও কুরআনী জ্ঞান সম্পর্কে লোকপাত করবো। অনুরূপ তকদীরের লেখক ফিরেশতার জ্ঞান সম্পর্কেও আলোচনা করবো। হুযুর আলাইহিস সালামের জ্ঞানের বিস্তার প্রমাণ করার জন্যেই এসব বিষয়ের আবতারণা করা হবে। -সুত্রঃ জা’আল হক ১ম খন্ড-
ইলমে গায়ব সম্পর্কিত আকীদা বা মতবাদ ও ইলমে গায়বের বিবিধ পর্যায়ের বর্ণনা
ইলমে গায়ব তিন ধরনের রয়েছে এবং এদের পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে । (খালিসুল ইতেকাদ গ্রন্থের ৫ পৃষ্ঠা হতে সংগৃহীত) ।
প্রথম প্রকারঃ-
১) মহান আল্লাহ তাআলা সত্ত্বাগত ভাবেই জ্ঞানী । তিনি অবগত না করালে কেউ একটি অক্ষরও জানতে পারে না ।
২) আল্লাহ তাআলা হুযুর আলঅইহিস সালাম ও অন্যান্য আম্বিয়া কেরাম (আলাইহিস সালাম) কে তাঁর আংশিক অদৃশ্য বিষয়াদি জ্ঞান দান করেছেন ।
৩) হুযুর আলাইহিস সালামের জ্ঞান সমস্ত সৃষ্টিকূল থেকে বেশী । হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) ও খলীল (আলাইহিস সালাম) মৃত্যুর ফিরিশতা এবং শয়তানও সৃষ্টিকূলের অন্তর্ভূক্ত ।
এ তিনটি বিষয় ধর্মের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়াদির অন্তর্ভূক্ত বিধায় এগুলো অস্বীকার করা কুফর ।
দ্বিতীয় প্রকারঃ-
১) আম্বিয়া কিরাম (আলাইহিস সালাম) এর মাধ্যমে আওলিয়া কিরাম (রহমতুল্লাহে আনহু) ও ইলমে গায়বের কিয়দংশ পেয়ে থাকেন ।
৪) আল্লাহ তাআলা হুযুর আলাইহিস সালাকে পঞ্চ গায়বের অনেক ক্ষেত্রে সুবিস্তৃত জ্ঞান দান করেছেন ।
যে এ দ্বিতীয় প্রকারের ইলমে গায়বকে অস্বীকার করবে সে পথভ্রষ্ট ও বদময হাবী বলে গণ্য হবে । কেননা এটা শত শত হাদীছকে অস্বীকার করার নামান্তর ।
তৃতীয় প্রকারঃ-
১) কিয়ামত কখন হবে সে সম্পর্কেও হুযুর আলাইহিস সালাম জ্ঞান লাভ করেছিলেন ।
২) বিগত ও অনাগত ভবিষ্যতের সমস্ত ঘটনাবলী যা লওহ মাহফুজে সুরক্ষিত আছে সে সবের জ্ঞান বরং এর চেয়েও বেশী জ্ঞান হুযুর আলাইহিস সালামকে দান করা হয়েছে ।
৩) হুযুর আলাইহিস সালামকে রূহের হাকীকত বা নিগুঢ় তত্ত্ব এবং কুরআনের সমস্ত অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক বিষয়াদির জ্ঞান দান করা হয়েছে । -সুত্রঃ জা’আল হক ১ম খন্ড-
ইলমে গায়েব সম্পর্কে যে বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখা দরকার
ইলমে গায়বে অবিশ্বাসীগণ যখন তাদের বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণাদি উপস্থাপন করে তখন নিম্নলিখিত বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন ।(এজহাতুল গায়ব গ্রন্থের ৪র্থ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য ।)
১) উপস্থাপিত আয়াতটি সুষ্পষ্ট ও অকট্রভাপবে ব্যাখ্যাকৃত হতে হবে যা বিবিধ অর্থ বোধক বা রূপক ব্যাখ্যার যোগ্য হলে চলবে না । আর হাদীছ উপস্থাপিত করা হলে হাদীছটি রেওয়ায়েতের দিক থেকে মুতাওয়াতির হতে হবে । (সাহাবায়ে কিরাম তাবেয়ীন ও তাবেয়ে তাবেয়ীন এ ৩টি যুগেই যে হাদীছের অগণিত বর্ণনাকারী হয় উহাই হাদীছে মুতাওয়াতির ।)
২) ঐ আয়াত বা হাদীছ যেন জ্ঞান দান করার বিষয় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয় অর্থাৎ আল্লাহ জ্ঞান দান করেনি কিংবা আমাকে এ জ্ঞান দান করা হয়নি এ ধরনের অস্বীকৃতির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত থাকতে হবে ।
৩) কোন বিষয়কে প্রকাশ না করলে তাতে সে বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞানতা বোঝা যায় না। এমনও হতে পারে যে প্রিয় নবী হুযুর (আলাইহিস সালাম) কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু কোন বিশেষ কারণে উহা ব্যক্ত করেননি । অনুরূপভাবে হুযুর আলাইহিস সালামের এ কথা বলা যে আল্লাহ জানেন আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা কিংবা আমি কি জানি? ইত্যাদি বাক্য দ্বারা হুযুর আলাইহিস সালামের জ্ঞানের অস্বীকৃতি বোঝা যায় না । এ ধরনের উক্তি সত্ত্বাগত জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন ও উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে নীরব রাখার জন্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।
৪) যে বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয় সে বিষয়টি যেন কোন ঘটনা সম্পর্কিত হয় ও উহা কিয়ামত পর্যন্ত সময় সিমানার মধ্যে হয় । কেননা আল্লাহর যাবতীয় গুনাবলী ও কিয়ামতের পরবর্তী বষয়াদি সম্পর্কিত জ্ঞানের আমরাও দাবী করি না ।
এ চারটি পরিচ্ছেদের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। -সুত্রঃ জা’আল হক ১ম খন্ড-
কুরআনী আয়াত দ্বারা ইলমে গায়েবের প্রমাণ
আল্লাহ তায়ালা বলেন-
(১) وَعَلَّمَ ادَمَالْاَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ
(এবং আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) কে সমস্ত কিছুর নাম শিখিয়ে দিলেন । অতঃপর সে সমস্ত বস্তু ফিরিশতাদের কাছে উপস্থাপন করলেন ।)
তাফসীরে মাদারেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছেঃ
وَمَعْنَى تَعْلِيْمِه اَسْمَاءِ الْمُسَمِّيَاتِ انَّهُ تَعَالَى اَرَاهُ الاَجْنَاسَ الَّتِىْ خَلَقَهَا وَعَلَّمَهُ اَنَّ هذَا اِسْمُه‘ فَرَسٌ وَهذَا اِسْمُه‘ بَعِيْرٌ وَهذَا اِسْمُهَ كَذَا وَعَنْ اِبْنِ عَبَّسٍ عَلَّمَهُ اِسْمَ كُلِّ شَئْىٍ حَتّ الْقَصْعَةَ وَالْمَغْرَ فَةَ
(হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) কে সমস্ত বস্তুর নাম শিক্ষা দেয়ার অর্থ হচ্ছে-আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাঁর সৃষ্ট সব কিছু দেখিয়েছেন এবং বলে দিয়েছিন যে এটার নাম ঘোড়া ঐটার নাম উট এবং ওটার নাম অমুক । হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে তাঁকে প্রত্যেক কিছুর নাম, শিখিয়ে দিয়েছেন এমন কি পেয়ালা ও কাঠের চামচের নাম পর্যন্ত ।
তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় একই কথা বলা হয়েছে তবে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হয়েছে যে-
وَقِيْلَ عَلَّمَ ادَمَ اَسْمَاءَ الْمَلَئِكَةِ وَقِيْلَ اَسْمَاءَ ذُرِّيَّتِه وَقِيْلَ عَلَمَّهُ اللَّغَاتَ كُلَّهُا
(কারো মতে আদম (আলাইহিস সালাম) কে সমস্ত ফিরিশতাদের নাম কারো মতে তার সন্তান সন্ততিদের নাম আবার কারো মতে সমস্ত ভাষা শিখানো হয়েছিল)
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে কবীরে লিখা হয়েছেঃ-
قَوْلُه اَىْ عَلَّمَهُ صفَاتَ الْاَشْيَاءِ وَنَعُوْ تَهَا وَهُوَ الْمَشْهُوْرُ اَنَّ الْمُرَالدَ اَسْمَاءُ كُلِّشَئْىِ مِنْ خَلْفٍ مِنْ اَجْنَاسِ الْمُحَدَثَاتِ مِنْ جَمِيْعِ اللُّغَاتِ الْمُخْتَلِفَةِ الَّتِىْ يَتَكَلَّمُ بِهَا وَلَدُ ادَمَ الْيَوْمَ مِنَ الْعَرَبِيَّةِ وَالْفَارِسِيَّةِ وَالرُّوْ مِيَّةِ وَغَيْرِهَا
(আদম (আলাইহিস সালাম) কে সমস্ত বস্তুর বৈশিষ্ট্য ও অবস্থাদি শিক্ষা দিয়েছেন । এ কথাই প্রসিদ্ধ লাভ করেছে যে সৃষ্টবস্তু দ্বারা বোঝানো হয়েছে অচিরন্তন প্রত্যেক বস্তুর নাম সমূহ যেগুলো বিভিন্ন ভাষায় প্রচলিত হবে ও যে নামগুলো আজ পর্যন্ত আদম সন্তান সন্ততিগণ আরবী ফার্সী রুমী ইত্যাদি ভাষায় ব্যবহার করে আসছে ।
তাফসীরে আবুস সাউদে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছেঃ
وَفِيْلَ اَسْمَاءَ مَاكَانَ وَمَا يَكُوْنُ وُقِيْلَ اَسْمَاءِ خَلْقِه مِنَ الْمَعْقُوْ لاَتِ وَالْمَحْسُوْسَاتِ وَالْمُتَخَيَّلَاتِ وَالمَوْهُوْ مَاتِ وَالْهَمَهُ مَعْرَفَةَ ذَوَاتِ الْاَشْيَاءِ وَاَسْمَءَ هَاخَوَ الصَهَا وَمَعَارِ فَهَا اُصُوْلَ الْعِلْمِ وَقَوَانِيْنَ الصَّنْعَاتِ وَتَفَاصِيْلَ لْاَتِهَا وَكُيْفِيَةَ اِسْتِعْمَالَاتِهَ
(কারো মতে আদম (আলাইহিস সালাম) কে অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত বিষয়ের নাম শিখিয়েছিলেন। ইন্দ্রিয়াতীত ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য কাল্পনিক ও খেয়ালী সবকিছুই শিক্ষা দিয়েছিলেন সব কিছুর সত্ত্বা নাম বৈশিষ্ট্য পরিচিতি জ্ঞান বা বিদ্যার নিয়মাবলী পেশা ও কারিগরী নীতিমালা এবং সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ও সাজসর ক্রোমের বিস্তারিত বর্ণনা ও সেগুলোর ব্যবহার প্রণালী আদম (আলাইহিস সালাম) কে অবহিত করেছিলেন।)
তাফসীরে রুহুল বয়ানে আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ-
وَعَلَّمَه‘ اَحْوَالَهَا وَمَا يَتَعَلَّقَ بِهَا مِنَالْمَنَافِعِ الدِّيْنِيَّهِ وَالدُّنْيَوِيَّةِ وَعَلَّمَ اَسْمَاءَ الْمَلَا ئِكَةِ وَاَسْمَاءِ ذُرِّيَّتِهِ وَاَسْمَاءَ الْحَيْوَانَاتِ وَالْجَمَادَاتِ وَصَنْعَةَ كُلِّ شَئْىٍ وَاَسْمَاءَ الْمُدْنِ وَالْقُرَى وَاَسْمَاءَ الطَّيْرِ وَالشَّجَرِ وَمَا يَكُوْنُ وَاَسْمَاَءِ كُلِّ شَئْىٍ يَخْلُقُهَا اِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَاَسْمَاءَ الْمَطْعُوْ مَاتِ وَالْمَشْرُوْبَاتِ وَكُلِّ نَعِيْمِ فِى الْجَنَّةِ وَاَسْمَاءَ كُلِّ شَيْئٍ وَفِى الْخَبْرِ عَلَّمَهُ سَبْعَ مِاَئةِ اَلْفِ لُغَاتٍ
(হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) সমস্ত জিনিসের অবস্থাদি শিখিয়েছেন এবং এগুলোর অন্তর্নিহিত ধর্মীয়-পার্থিব উপকারিতার কথা বলে দিয়েছেন। তাকে ফিরিশতাদের নাম তার বংশধর জীব জন্তু ও প্রাণীবাচক বস্তু সমূহের নাম শিক্ষা দিয়েছেন প্রত্যেক জিনিস তৈরী করার পদ্ধতি সমস্ত শহর ও গ্রামের নাম সমস্ত পাখী বৃক্ষ রাজির নাম যা হয়েছে এবং যা হবে সবকিছুর নাম কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছুসৃষ্টি হবে সবকিছুর নাম যাবতীয় আহর্য দ্রব্য সামগ্রীর নাম বেহেশতের প্রত্যেক নিয়ামতের নাম মোট কথা প্রত্যেক কিছুর নাম শিখিয়ে দিয়েছিলেন । হাদীছ শরীফে আছে যে আদম (আলাইহিস সালাম) কে সাত লাখ ভাষা শিখিয়েছেন ।
উপরোক্ত তাফসীর সমূহ থেকে এতটুকু বোঝা গেল যে যা কিছু হয়েছে ও যা কিছু হবে সমস্ত কিছুর সম্পূর্ণ জ্ঞান হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) কে দান করা হয়েছে। তাকে বিভিন্ন ভাষাজ্ঞান দান করেছেন বিভিন্ন জিনিসের উপকারিতা ও অপকারিতা তৈরী করার পদ্ধতি যন্ত্রপাতির ব্যবহার সবকিছু দেখিয়ে দিয়েছেন । এখন আমাদের আকা মওলা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জ্ঞান ভাণ্ডার দেখুন। সত্যি কথা এই যে হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) এর এ ব্যাপক জ্ঞান নবী করিম আলাইহিস সালামের জ্ঞান সমুদ্রের এক ফোটা তুল্য বা ময়দানের এক কণা সদৃশ।
শাইখ ইবনে আরবী তদ্বীয় ফুতুহাতে মক্কীয়া গ্রন্থে দশম অধ্যায়ে বলেছেনঃ-
اَوَّلُ نَائِبٍ كَانَ لَهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَخَلِيْفَتُهَ اَدَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ
(অর্থাৎ হুযুর আলাইহিস সালামের প্রথম খলীফা ও প্রতিনিধি হলেন হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) । এতে বোঝা গেল যে, হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) হলেন হুযুর আলাইহিস সালামের খলীফা । খলীফা হচ্ছেন তিনিই, যিনি আসমান বা প্রকৃত মালিকের অনুপস্থিতিতে তাঁর স্থলাভিশিক্ত হয়ে কাজ করেন। হুযুর আলাইহিস সালামের জন্মের আগেকার সমস্ত নবী (আলাইহিস সালাম) তারই প্রতিনিধি ছিলেন । এ কথাটি মৌলভী কাসেম ছাহেরও তদীয় তাহজীরুন নাস গ্রন্থে লিখেছেন যার বর্ণনা পরে করা হবে । এ হলো প্রতিনিধির ব্যাপক জ্ঞানের অবস্থা ।
কাযী আয়ায (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এর শেফা শরীফ এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ নসিমুর রিয়ায এ উল্লেখিত আছেঃ-
اِنَّهُ عَلَيْهِ السَّلَامُ عَرْضَتْ عَلَيْهِ الْخلَائِقُ مِنْ لَّدْنِ اَدَمَ اِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ فَعَرَفَهُمْ كُلُّهُمْ كَمَا عَلَّمَ اَدَمَ الْاَلسْمَاءَ كُلَّهَا
অর্থাৎ হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে আরম্ভ করে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত তার বংশজাত আওলাদকে হুযুর আলাইহিস সালামের সম্মুখে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। তিনি (সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাদের সবাইকে চিনেছিলেন যেমনিভাবে হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) কে সবকিছুর নাম শিখানো হয়েছিল।
এ ভাষ্য থেকে বোঝা গেল যে হুযুর (আলাইহিস সালাম) সবাইকে জানেন সকলকে চিনেন ।
(২) وَيَكُوْنَ لرَّسُوْلُ عَلَيْكُمْ شَهِيْدًا
(এ রসুল তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সাক্ষী হবেন ।) এ আয়াতির ব্যাখ্যায় তাফসীরে আযীযীতে লিখা হয়েছে- হুযুর (আলাইহিস সালাম) স্বীয় নবুয়তের আলোকে প্রত্যেক ধর্ম পরায়ণ ব্যাক্তির ধর্মের অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন । কোন ব্যক্তি ধর্মের কোন স্তরে পৌছেছেন তার ঈমানের হাকীকত কি এবং তার পরলৌকিক উন্নতির পথে অন্তরায় কি এসব কিছুইতিনি জানেন। সুতরাং হুযুর (আলাইহিস সালাম) তোমাদের বিশুদ্ধ চিত্ততা ও কপটতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল । এ জন্যই তো পৃথিবীতে উম্মতের পক্ষে বা বিপক্ষে তার সাক্ষ্য শরীয়তের বিধানমতে গ্রহণীয় এবং অবশ্যই পালনীয় ।
তাফসীরে রূহুল বয়ানে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছেঃ-
هَذَا مَبْنِىّ عَلَى تَضْمِيْنِ الشَّهِيْدِ مَعْنَى الرَّقِيْبِ وَالْمُطَلِّعِ وَالْوَجْهُ فِىْ اِعْتِبَارِ تَضْمِيْنِ الشَّهِيْدِ الْاِشَارَةُ اِلَى اَنَّ التَّعْدِيْلَ وَالتَّزْكِيَّةَ اِنَّمَا يَكُوْنُ عَنْ خُبْرَةِ وَمَرَاقَبَةٍ بِحَالِ الشَّاهِدِ وَمَعْنَى شَهَادَةِ الرَّسُوْلِ عَلَيْهِمْ اِطَّلَاعُهَ رُتَبَةَ كُلَّ مُتَدَينٍ بَدِيْنِه فَهُوَ يضعْرِفُ دَنَوْبَهُمْ وَحَقِيْقَةَ اِيْمَانِهِمْ وَاَعْمَالِهُمْ وَحَسَنَاتِهمْ وَسَيْئَاتِهِمْ وَاِخْلَاصِهُمْ وَنِفَاقِهُمْ وَغَيْرِ ذَالِكَ بِنُوْرِالْحَقِّ وَاُمَّتُهَ يَعْرِفُوْنَ ذَالِكَ مِنْ سَائِرِ الْاُمَمِ بِنُوْرِه عَلَيْهِ السَّلَامُ
অর্থাৎ এটা এ কারণেই যে আয়াতে উল্লেখিত شهيد শব্দটি রক্ষণাবেক্ষণাকারী ও ওয়াকিফহাল কথাটাও অন্তর্ভুক্ত করে এবং এ অর্থ দ্বারা একথারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কোন ব্যক্তির যথার্থতা ও দূষণীয় সাক্ষ্য প্রদান তখনই সম্ভবপর হবে, যখনই সাক্ষী উক্ত ব্যক্তির যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে সম্যকরূপে ওয়াকিফহাল হয়। হুযুর আলাহিস সালামের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তিনি প্রত্যেক ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে অবগত। সুতরাং বোঝা যায় যে হুযুর (আলাইহিস সালাম) মুসলমাদের গুনাহ সমূহ তাদের ইসলামের হাকীকত, তাদের ভালমন্দ কার্যাবলী তাদের আন্তরিকতা ও কপটতা ইত্যাদিকে সত্যের আলোর বদৌলতে অবলোকন করেন । হুযুর (আলাইহিস সালাম) এর নিকট ও তার নুরের ওসীলায় অন্যাণ্য সমস্ত উম্মতের অবস্থা ও কিয়ামতেন ময়দানে সস্পর্ণরূপে উদ্ভাসিত হবে।
তাফসীরে খাযেনে এ আয়াতেন ব্যাখায় লিখা হয়েছে
ثُمَّ يُؤْتَى بِمُحَمَّدٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ فَيُسْئَلُهُ عَنْ حَالِ اُمَّتِه فَيُزَ كِّيْهِمْ وَيَشْهَدُ بِصِدْقِهِمْ
(অতঃপর কিয়ামতের দিন হুযুর আলাইহিস সালামকে আহবান করা হবে। এর পর আল্লাহ তাআলা তাকে তার উম্মতের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। তখন তিনি তাদের পবিত্রতা ও সত্যতার সাক্ষ্য দিবেন )
(তাফসীরে মাদারেকে ২য় পারার সূরায়ে বাকারার এ আয়াতের তাফসীরে লিখা হইয়াছেঃ-
فَيُؤْتَى بِمُحَمَّدٍ فَيُسْئَلُ عَنْ حَالِ اُمَّتِه فَيُزَ كِّيْهِمْ وَيَشْهَدُ بِعَدَ الَتِهِمْ وَيُزَ كِّيْهِمْ وَيَعْلَمُبِعَدَا لَتِكُمْ
অর্থাৎ অতঃপর হুযুর (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) আহবান করা হবে তার উম্মতের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তখন তিনি স্বীয় উম্মতের সাফাই বর্ণনা করবেন এবং তাদের ন্যায় পরায়ণ ও যথার্থ হওয়া সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন। সুতরাং হুযুর আলাইহিস সালাম আপনাদের যথার্থতা সম্পর্কে অবগত আছেন ।
এ আয়াত ও তাফসীর সমূহে এটাই বলা হয়েছে যে কিয়ামতের দিন অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কিরামের (আলাইহিস সালাম) উম্মতগণ আল্লাহর দরবারে আরয করবে হে আল্লাহ! আমাদের কাছে তোমার কোন নবী আগমন করেননি। পক্ষান্তরে ঐ সমস্ত উম্মতের নবীগণ আরয করবেনঃ হে খোদা আমরা তাদের কাছে গিয়েছি তোমার নির্দেশাবলী তাদের কাছে পৌঁছিয়েছি কিন্তু তারা গ্রহণ করেনি । আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নবীগণকে বলা হবে যেহেতু তোমরা বাদী সেহেতু তোমাদের দাবীর সমর্থনে কোন সাক্ষী উপস্থাপন কর । তারা তখন তাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে হুযুর (আলাইহিস সালামের উম্মতকে পেশ করবেন। তারা সাক্ষ্য দেবেন হে আল্লাহ । তোমার নবীগণ সত্যবাদী তারা তোমার নির্দেশাবলী স্ব স্ব উম্মতের কাছে পৌছিয়েছিলেন ।
এখানে দুটি বিষয়ের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা দরকার।
প্রথমতঃ- মুসলমানগণ সাক্ষ্য দেয়ার উপযুক্ত কিনা। (ফাসিক, ফাজির ও কাফিরদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। একমাত্র পরহেযগার মুসলমানদের সাক্ষ্যই গ্রহণযোগ্য।) দ্বিতীয়তঃ- এ সমস্ত লোকগণ তাদের পূর্বেকার নবীগণের জামানা দেখেননি । তবুও তারা কিভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছেন । মুসলমানরা আরয করবেন ‘হে খোদা! আমাদেরকে তোমার হাবীব মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন যে, আগেকার নবীগণ ধর্ম প্রচার করেছিলেন। এটা শুনেই আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি। তখন হুযুর আলাইহিস সালামকে আহবান করা হবে ।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ) দুটি বিষয়ের সাক্ষ্য দিবেন। একটি হলো এ সমস্ত লোকগণ এমন পাপিষ্ট বা কাফির নয় যে তাঁতের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং তাঁরা পরহেযগার মুসলমান। অন্যটি হলো তিনি (সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলবেন-হ্যাঁ, আমিই তাদেরকে বলেছিলাম যে আগেকার নবীগণ নিজ নিজ উম্মতের কাছে খোদার ফরমান পৌঁছিয়েছিলেন ।
অতঃপর ঐ সব নবীগণের পক্ষে রায় দেয়া হবে ।
এ বর্ণনা থেকে নিম্নোল্লেখিত কয়েকটি বিষয় জানা গেল ।
একঃ- হুযুর আলাইহিস সালাম কিয়ামত পর্যন্ত ভূ-পৃষ্ঠে আগমণকারী মুসলমানদের ঈমান, আমল, রোযা, নামায ও নিয়ত সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত । নচেৎ তাদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়া কিভাবে সম্ভব? কোন মুসলমানের অবস্থা তার দৃষ্টি বহির্ভূত হতেই পারে না । হযরত নূহ (আলাইহিস সালাম) তাঁর কওমের ভবিষ্যৎ বংশধরদের অবস্থা জেনে আবেদন করেছিলেন- হে খোদা! এদের বংশোদ্ভূত লোকগণও পাপিষ্ট ও কাফির হবে । সুতরাং, তুমি তাদেরকে ডুবিয়ে দাও। হযরত খিযির (আলাইহিস সালাম) যে শিশুটিকে হত্যা করেছিলেন, তার ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্পর্কে অবগতি লাভ করে বুঝতে পেরে ছিলেন যে, যদি সে জীবিত থাকে তবে আবাধ্য হবে তাহলে হুযুর আলাইহিস সালামের কাছে কারো অবস্থা কিভাবে গোপন থাকতে পারে?
দুইঃ- পূর্ববর্তী নবীগণ ও তাঁদের উম্মতগনের অবস্থা হুযুর আলাইহিস সালাম নূরে নবুয়তের বদৌলতে অবলোকন করেছিলেন এবং তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে সাল্লাম) সাক্ষ্যটা ছিল একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য। যদি তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সাক্ষ্য শ্রুত বিষয়ের সাক্ষ্য হতো, তাহলে এ ধরনের সাক্ষ্য মুসলমানরা তো আগেই দিয়েছে । শ্রুত বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণের সর্বশেষ পর্যায়ে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নেয়া হয় ।
তিনঃ- এ থেকে আরও বোঝা গেল যে, আল্লাহ তাআলা-নবী যে সত্যবাদী, তা জানা সত্ত্বেও সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে রায় দেন অনুরুপ যদি হুযুর আলাহিস সালাম, বিচার কার্য তদন্ত করেন এবং সাক্ষ্য প্রমাণ করেন, তখন এ কথা বলা যাবেনা যে, হুযুর আলাইহিস সালাম সে বিষয়ে অবগত নন। দায়েরকৃত মুকাদ্দমায় এটায় নিয়ম। (এ ব্যাপারে আর ও বিস্তারিত জানতে হলে আমার রচিত কিতাব শানে হাবীবুর রহমান-দেখুন) এ সাক্ষ্যের উল্লেখ পরবর্তী আয়াতের মধ্যেও রয়েছে।
৩) وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيْدًا
অর্থাৎ যে মাহাবুব (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আমি আপনাকে এদের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে আনব ।
তাফসীরে নিশাপুরীতে” এ আয়াতের তাফসীরে উল্লেখিত আছে ।
لِاَنَّ رُوْحَهُ عَلَيْهِ السَّلَامُ شَاهِدٌ عَلَى جَمِيْعِ الْاَرْوَاحِ وَالْقُلُوْبِ وِالنَّفُوْسِ بِقَوْلِه عَلَيْهِ السَّلَامُ اَوَّلُ مَاخَلَقَ اللهُ نُوْرِىْ
অর্থাৎ এটা এ কারনে যে হুজুর আলাইহিস সালামের রুহ মোবারক সমস্ত রুহ দিল ও সত্তা সমুহকে দেখতে পান । কেননা তিনিই বলেছেন- আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম যা সৃষ্টি করেছেন’ তা হলো আমার নূর ।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে রুহুল বয়ানে আছেঃ-
وَاعْلَمْ اَنَّهُ يُعْرَضُ عَلَى النَّبِىْ عَلَيْهِ السَّلَامُ اَعْمَالُ اُمَّتِهِ غَدَوْةً وَعَشِيَّةً فَيَعْرِ فُهمْ بِسِيْمَاهُمْ اَعْمَالَهُمْ فَلِذَالِكَ يَشْهَدُ عَلَيْهِمْ
হুজুর আলাইহিস সালামের কাছে তার উম্মতের আমলসমূহ সকাল বিকাল পেশ করা হয়। তাই তিনি উম্মকতকে তাদের চিহ্ন দৃষ্টে চিনেন ও তাদের কার্যাবলী সম্পর্কে অবগত হন। এজন্য তিনি রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাদের ব্যপারে সাক্ষ্য দিবেন ।
তাফসীরে মাদারেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছেঃ
اَىْ شَاهِدً عَلَى مَنْ اَمَنَ بِالْاِيْمَانِ وَعَلَى مَنْ كُفُرَ بِالْكُفْرِ وَعَلَى مَنْ نَافَقَ بِالنِّفَاقِ
অর্থাৎঃ হুজুর আলাইহিস সালাম মুমিনদের জন্য তাদের ঈমানের’ কাফেরদের জন্য তাদের কুফরীর জন্য ও মুনাফিকদের জন্য মুনাফেকীর সাক্ষী।
এ আয়াত ও তাফসীর সসূহ দ্বারা বোঝা গেল যে, হুযুর আলাইহিস সালাম সৃষ্টির আদিকাল থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত লোকের কুফর, ঈমান, কপটতা, আমল ইত্যাদি সব কিছুই জানেন। এ জন্যইতো তিনি সকলের জন্য সাক্ষী। একেইতো বলে ‘ঈলমে গায়ব’ বা অদৃশ্য জ্ঞান।
৪) مَنْ ذَالَّذِىْ يَشْفَعُ عِنْدَهُ اِلَّبِاِذْنِه يَعْلَمُ مَا بَيْنَ اَيْدِيْهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ
(কে সে, যে তার কাছে তার অনুমতি ব্যতীত সুপারিশ করবে? তিনি তাদের পূর্বাপর সবকিছুই জানেন।)
তাফসীরে নিসশাপুরেীতে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখ হয়েছেঃ-
يَعْلَمُ مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَابَيْنَ اَيْدِيْهِمْ مِنْ اَوَّلِيَّابِ الْاَمْرِ قَبْلَ الْخَلَائِقِ وَمَا خَلْفَهُمْ مِنْ اَحْوَالِ الْقِيَامَةِ
অর্থাৎ হুযুর আলাইহিস সালাম সৃষ্টির আগেকার অবস্থাদি জানেন এবং সৃষ্টির পরে কিয়ামতের যে ভয়াবহ অবস্থাদি সংঘটিত হবে, তা’ও তিনি জানেন।
Comments