[ad_1]
শবে বরাত
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আয্হারী
খতিব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ, নন্দনকানন, চট্টগ্রাম। লেকচারার, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
بسم الله الرحمن الرحيم
যে সমস্ত বরকতময় রজনীতে আল্লাহ্পাক তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করে থাকেন, শবে বরাত তারই অন্যতম। তাফসীর-হাদিস ও বিজ্ঞ আলিমদের পরিভাষায় যাকে “লাইরাতুন নিছ্ফি মিন শাবান” বা শাবানের মধ্য রজনী নামে অভিহিত করা হয়। যে রাতটি হলো শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, সলফে সালেহীনগণ এবং বিজ্ঞ মনীষীগণ এ রাতটিকে অত্যন্ত গুরুত ¡সহকারে পালন করেছেন। অনুরূপভাবে যুগে যুগে মুসলমানগণ এরই ধারাবাহিকতায় এ রাতটি পালন করে আসছেন।
নামকরণ: “শবে বরাত” ফার্সী শব্দ, ’শব’ মানে রাত আর ’বরাত’ মানে ভাগ্য, অর্থাৎ ভাগ্যরজনী। আর এ পবিত্র রাতের বিভিণœ নাম পাওয়া যায়। ১. লাইয়লাতুল বরাত বা বণ্টনের রাত, ২. লাইলাতুল মুবারাকা বা বরকতময় রজনী ৩. লাইলাতুর রহমা বা করুনার রজনী ও ৪. লাইলাতুছ্ ছাক বা সনদপ্রাপ্তির রাত।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি রচিত গুনিয়াতুত্ ত্বালেবীন এ উল্লেখ করেন: ‘এ রাতকে লাইলাতুল বরাত বলা হয় এ জন্য যে, কেননা এ রাতে দু’ধরনের বরাত হাছিল হয়। একটি হলোঃ হতভাগাদের আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া, অপরটি হলোঃ আল্লাহর প্রিয়জনদের অপমান থেকে মুক্ত ও নিরাপদ থাকা।’’ (গুনইয়াতুত তালেবীন: হযরত আবদুল কাদের জিলানী)
আল কোরআনে শবে বরাত: আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন: “হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, আমিই প্রেরণকারী। আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা দুখান, আয়াত: ০১-০৬) আল্লামা জমখ্শরী তাঁর ‘কাশ্শাফ’ নামক তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেন- ‘‘নিশ্চয় শাবানের মধ্য রজনী’র চারটি উল্লেখযোগ্য নাম রয়েছে, আর তা হলো- লাইলাতুল মুবারাকা (বরকতময় রজনী) লাইলাতুল বরায়া (ভাগ্য রজনী) লাইলার্তু রহমাহ্ (করুনার রজনী) ও লাইলাতুছ্ ছাক (সনদপ্রাপ্তির রজনী) এ রাতকে বরাত ও ছাক রাত নামে নামকরণের কারণ হিসেবে বলেন- যখন কোন ব্যক্তি তার উপর ধার্যকৃত কর পরিশোধ করেন তখন তাকে কর আদায়কারী ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি দায়মুক্তির সনদ দেয়া হয়, অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা’লা তাঁর প্রিয় বান্দাদের এ রাত্রিতে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদ প্রদান করে থাকেন।’’ [তাফসীর-ই কাশ্শাফ: আল্লামা জমখ্শরী]
তাছাড়া, ইমাম কুরতবী তাঁর তাফসীরের প্রসিদ্ধ গ্রন্থে পবিত্র ক্বোরআনের ‘সূরা দুখান’ এর আয়াত ০৩ এর ব্যাখ্যায় বলেন: ”এ রাতটির চারটি নাম উল্লেখ রয়েছে। আর তাহলো- লাইলাতুল মুবারাকাহ্ ও লাইলাতুছ্ ছাক। আর এ রাতকে ‘বরকতময় রজনী’ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা এ রাতে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের উপর অগণিত বরকত, কল্যাণ ও পূণ্য অবতীর্ণ করে থাকেন।
হযরত ক্বাতাদাহ্ (র.) ওয়াছিলাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন: ক্বোরআন অবতীর্ণ হওয়া আরম্ভ হয় শবে বরাতের রাতে। ইকরামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, লাইলাতুল মুবারাকাহ্ মানে এখানে ‘শবে বরাত’কে বুঝানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন: হযরত ইকরামা বলেন, এটি হলো শাবানের মধ্য রজনী (শবে বরাত) আগত বছরের বিষয়াদি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কারা জীবিত থাকবে এবং কারা মারা যাবে, কারা এ বছর হজ্ব করবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে এতে কেউ কোনরূপ পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারে না। হযরত ওসমান ইবনে মুগিরাহ্ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, শাবান থেকে শাবানের জন্য মানুষের আয়ু নির্ধারণ করা হয়, এমনি মানুষ বিবাহ্ করছে এবং তার সন্তান জন্ম লাভ করছে অথচ তার নাম মৃতদের কাতারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
‘আল্ আ’রুস’ নামক কিতাবের লেখক এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, যে রাতে সবকিছু বণ্টন করা হয় তা হলো শাবানের মধ্য রজনী বা শবে বরাত। এজন্য এটাকে বরাত রজনী বলা হয়। আল্লামা জমখ্শরী বলেন- ‘লওহে মাহ্ফুজ’ এ লিপিবদ্ধকরণ শুরু হয় শবে বরাতে এবং তার পরিসমাপ্তি ঘটে শবে ক্বদরে। অতঃপর রিজিকের কপি দেয়া হয় হযরত মিকাঈল আলাইহিস্ সালামকে, যুদ্ধের কপি হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালামকে, অনুরূপভাবে ভূমিকম্প, বজ্রপাত ও ভূমিধ্বস বিষয়ক কপিও। আমলনামার কপি প্রথম আসমানের মহান ফিরিশতা হযরত ইসমাঈলকে এবং বিপদাপদের কপি হযরত আজরাঈল তথা মালাকুল মাওতকে সোপর্দ করা হয়।
হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বর্ণনা করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা নানা বিষয়ে ফয়সালা প্রদান করেন শাবানের মধ্য রজনীতে এবং তা এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিরিশতাদের নিকট সোপর্দ করেন ক্বদরের রাতে।
হাদীস শরীফের আলোকে শবে বরাত: পবিত্র শাবান মাস এবং এ মাসে রোজা পালনের উপর বোখারী, মুসলিম ও তিরমিযীসহ অনেক বিশুদ্ধ হাদিসগ্রন্থের বর্ণনা আমরা লক্ষ্য করেছি। অনুরূপভাবে এ মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত তথা শবে বরাত সম্পর্কে ছেহাহ্ ছিত্তাহর উল্লেখযোগ্য কিতাবাদিসহ নানা নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে প্রমাণ মেলে। ১। ছহীহ্ ইবনুল হিব্বান-এ হযরত মুয়ায রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত: , ‘যখন শাবানের মধ্য রজনী (শবে বরাত) উপস্থিত হয় তখন এক আহ্বানকারী এ আহবান করতে থাকে, ‘‘কোনও ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো কোন প্রার্থী বা ফরিয়াদী আছো কি? আমি তার প্রার্থনা ও ফরিয়াদ কবুল করব? ফলে যে যা প্রার্থনা করবে তাকে তা দেয়া হবে। একমাত্র যেনাকারী ও মুশরিককে নয়। (ছহীহ্ ইবনুল হিব্বান) ২। সুনানে ইবনে মাযা শরীফে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামএরশাদ করেন- ”যখন শাবানের মধ্য রজনী উপস্থিত হবে, তখন তোমরা এ রাতটিকে (ইবাদতের মাধ্যমে) উদ্যাপন কর এবং আগত দিনটিকে রোজার মাধ্যমে। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা ওই রাতের সূর্যাস্তের পরক্ষণ থেকেই পৃথিবীবাসীর প্রতি বিশেষ করুণার দৃষ্টি প্রদান করেন এবং এ ঘোষণা দেন- আছ কি কেউ ক্ষমা চাওয়ার? তাকে ক্ষমা করবো। আছ কি কেউ রিযিক প্রার্থনা করার? রিযিক দ্বারা ধন্য করবো। আছ কি কেউ অসুস্থ ? তাকে আরোগ্য দান করবো। আছ কি এমন কেউ? আছে কি এমন কেউ? সুবহে সাদেক উদিত হওয়া পর্যন্ত এভাবে বলা হবে। (সুনানে ইবনে মাযা) ৩। তিরমিযী শরীফে হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- ‘এক রজনীতে আমি প্রিয়নবীকে বিছানায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ফলে তাঁকে খোজার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে পড়লাম। হঠাৎ দেখি তিনি জান্নাতুল বক্বীতে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে দিয়ে দোয়ারত আছেন। আমাকে দেখে হুযূর করীম বললেন, তুমি কি এ ভয় করছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি অন্যায় করবেন? আমি বললাম, এয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আপনার অন্য কোন স্ত্রীর গৃহে প্রবেশ করেছেন। তখন হুযূর করীম বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা শাবানের মধ্য রজনীতে প্রথমাকাশের দিকে বিশেষ কৃপাদৃষ্টি দান করেন এবং ’কলব’ গোত্রের ছাগলের পশমেরও অধিক পরিমাণ গুনাহগারকে ক্ষমা করেন।( তিরমিযী শরীফ) ৪। ‘সুনানে ইবনে মাযাতে হযরত আবু মুসা আশয়ারী থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা শাবানের মধ্য রজনীতে রহমত ভরা দৃষ্টিতে গুনাহগারদের দিকে তাকান, ফলে সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন, একমাত্র মুশরিক ও অন্য মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতিরেকে। (‘সুনানে ইবনে মাযাত) ৫। ‘মুসনাদে আহমদ’এ হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আছ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত- প্রিয় নবী এরশাদ করেন, সাবানের মধ্য রজনীতে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির প্রতি বিশেষ করুণার দৃষ্টি প্রদান করেন এবং সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন; কিন্তু দুই শ্রেণীর মানুষকে নয়, বিদ্বেষ পোষণকারী ও আত্মহত্যাকারীকে।( ‘মুসনাদে আহমদ) ৬। হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামএরশাদ করেন- আল্লাহ্ তা‘আলা যখন শাবানের মধ্য রজনী উপস্থিত হয় তখন পৃথিবীর আকাশে রহমতের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং সকল শ্রেণীর বান্দাদের ক্ষমা করেন, একমাত্র মুশরিক ও মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষপোষণকারীকে ছাড়া। (‘মুসনাদে বাজ্জাজ’) ৭। ‘লাতায়েফুল মা’রেফ’ এ কা’ব থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন- আল্লাহ্ তা‘আলা শাবানের মধ্য রজনীতে জিব্রাঈল (আ.) কে বেহেশতের প্রতি এ নির্দেশ দিয়ে পাঠান যে, বেহেশত যেন নিজেকে নানা সাজে সজ্জিত করে এবং জিব্রাঈল যেন বেহেশতকে উদ্দেশ্য করে এ সুসংবাদ শুনায়: নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমার এ রাত্রিতে মুক্ত করে দিয়েছেন আকাশের তারকারাজির সমপরিমাণ, পৃথিবীর রাত-দিনের সংখ্যা পরিমাণ, বৃক্ষের পত্র-পল্লবের সমপরিমাণ, পাহাড় সমূহের ওজনের সমপরিমাণ এবং বালুরাশির সমপরিমাণ অসংখ্য অগণিত মানুষকে।(পৃষ্ঠা-১৩৮) ৮। ‘মুসনদে বাযযায’ এ হযরত আতা ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন- ‘শাবানের মধ্য রজনীতে আয়ূ নির্ধারণ করা হয়। ফলে দেখা যায় কেউ সফরে বের হয়েছে অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, আবার কেউ বিয়ে করছে অথচ তার নাম জীবিতের খাতা থেকে মৃতের খাতায় লিখা হয়ে গেছে।(হাদিস নং: ৭৯২৫) ৯। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আরা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- পাঁচটি রজনীতে দোয়া প্রত্যাখ্যাত হয় নাঃ জুমার রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শাবানের মধ্য রজনী এবং দুই ঈদের রাত। (‘মুসনদে বাযযায’: ৭৯২৭ ১০। ‘মু’জাম আল কাবীর’ এ হযরত মুয়ায ইবনে জবল থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- ‘আল্লাহতা‘আলা শাবানের মধ্য রজনীতে স্বীয় সৃষ্টির প্রতি বিশেষ করূণার দ্বার উন্মুক্ত করে দেন এবং সকল সৃষ্টিকেও ক্ষমা করে দেন এবং শুধু মাত্র মুশরিক ও বিদ্বেষীকে ছাড়া।(হা-৬৭৭২) ১১। অনুরূপভাবে ‘মুজাম আল কাবীর’ এ আবু ছা’লাবাহ্ থেকে বর্ণিত: প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামএরশাদ করেন, আল্লাহস্বীয় বান্দাদের প্রতি শাবানের মধ্য রজনীতে করুণা ভরা হৃদয়ে ক্ষমার দৃষ্টিতে তাকান, ফলে মুমিনদের ক্ষমা করে দেন এবং কাফিরদেরকে ইমান আনার সুযোগ দেন আর হিংসুকদেরকে তাদের হিংসার মাঝে ছেড়ে দেন, যতক্ষণ না তারা তাদের হিংসা বিদ্বেষ ত্যাগ করে। (হা- ২২৩) ১২। হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামএরশাদ করেন- নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা শবে বরাতের মধ্য রজনীতে পৃথিবীর আকাশে রহমত অবতারণ করেন এবং পৃথিবীর সকল মানুষকে ক্ষমা করে দেন। একমাত্র কাফির এবং যার অন্তরে বিদ্বেষ বিদ্যমান।(ঊসুলু ্ ইতিকাদি আহলিস্ সুন্নাহ.হা :৭৫০)
ক্স সালফে ছালেহীনের দৃষ্টিতে শবে বরাত:
মোল্লা আলী আলক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, মিশকাত শরীফ এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘মিরকাত’ এ বলেন- ‘সালফে ছালেহীনদের বড় একটি অংশ বলেন, ‘আয়াত (সূরা দুখান-১-৪) দ্বারা শাবানের মধ্য রাতকে বুঝানো হয়েছে। এতে কোন বিরোধ নেই যে, শবে বরাতের রাত্রিতে বণ্টন কাজ সম্পন্ন হয়। বিরোধ হলো- এ আয়াত দ্বারা এ রাতকে বুঝানো হয়েছে কিনা। যদি তা দ্বারা শবে ক্বদর বুঝানো হয়, তাহলে হাদিস ও আয়াত উভয়ের সমন্বয়ে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, এ বণ্টনটি উভয় রাতে (শবে বরাত ও শবে ক্বদর) সম্পন্ন হয়েছে। যাতে এর গুরূত্ব আরও অধিকভাবে প্রমাণিত হয়। আবার এটাও হতে পারে যে, বণ্টন কাজটি এক রাতে সংক্ষেপে এবং অন্য রাতে বিস্তারিতভাবে সম্পন্ন হয়েছে। অথবা এক রাতে পার্থিব বিষয়াদি এবং অন্য রাতে পরকালীন বিষয়াদির বণ্টন সম্পন্ন করা হয়েছে। এ ছাড়াও আরও নানা সম্ভাবনাও থাকতে পারে।
ইবনে নুজাইম মিসরী ‘আল আশ্বাহ্ ওয়ান নাজায়ের’ নামক কিতাবে উল্লেখ করেন- কিছু সংখ্যক ওলামা বলেছেন, যদি জুমার রাত ও শাবানের মধ্য রাত একত্রিত হয়ে যায় তাহলে এ রাতটি উদ্যাপন করা মুসতাহাব। হ্যাঁ, তবে যদি এটিকে শুধু শবে বরাতের রাত ধরা হয়, তাহলে উদ্যাপন করা মুসতাহাব হবে, নাকি জুমার রাত হওয়াতে তা মাকরূহ হবে? তা নিয়ে কিছু সন্দেহ পোষণ করা হয়েছে। আর যারা মাকরূহ বলেছেন তারা হারামে লিপ্ত হওয়ার ভয়ে। কিন্তু তা হারাম হবে না, কেননা ইবাদতকারীর নিয়ত হলো- শবে বরাত।
মনসুর আল বাহুতী ‘কাশ্শাফুল কান্না’ নামক কিতাবে লিখেন- ‘নিশ্চয় শাবানের মধ্য রাতের অনেক ফজিলত বিদ্যমান। সালফে সালেহীনদের মাঝে অনেকেই এ রাতে নফল নামায আদায় করতেন। প্রিয় নবীর এ হাদিস তাদের সমর্থন করে। প্রিয়নবী এরশাদ করেন: যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাত ও শাবানের মধ্য রাত ইবাদতের মাধ্যমে উদ্যাপন করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তার ক্বলবকে জীবিত রাখবেন ওই দিনও, যে দিন অনেক ক্বলব মৃত্যুবরণ করবে। (তারীখে মুনজেরীতে তা বর্ণিত হয়েছে)। আরেক দল ওলামা বলেছেন- অনুরূপভাবে আশুরা (মহররম মাসের নয় তারিখ দিবাগত রাত)’র রাতে, রজব মাসের প্রথম রাতে ও শবে বরাতও।
ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘আল্ উম্ম’ নামক কিতাবে বলেন- ‘আমাদের নিকট এ সংবাদ পৌঁছেছে যে, বলা হয়ে থাকে, পাঁচটি রহমতময় রজনীতে দো‘আ কবুল হয়। জুমার রাতে, ঈদুল আযহার রাতে, ঈদুল ফিতরের রাতে, রজব মাসের প্রথম রাতে এবং শাবানের মধ্যরাতে। তিনি (শাফে‘ঈ) আরও বলেন, ‘আমি উপরোক্ত রাতগুলোকে উদ্যাপন করা মুসতাহাব মনে করি, যদি ফরজ মনে করা না হয়, তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নিকট প্রমাণিত যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর জুমার রাত উদ্যাপন করতেন।(সুনান আল কুবরা) উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, শবে বরাতের বিষয়ে বর্ণিত হাদিসসমূহ খুবই নির্ভুল এবং গ্রহণযোগ্য। এমনকি সালাফী (ওয়াহাবী) দাবীদারদের গুরু আলবানী সাহেবও এ হাদিসগুলো সহীহ ও নির্ভুল হিসেবে মেনে নিয়েছেন। (সিলসিলা: (৫১২,৫১১,৫১০,৫০৯)
ইবনে তাইমিয়াহ্: সালাফী ও ওহাবী মতবাদের অনুসারীদের ইমামে আজম! জনাব ইবনে তাইমিয়াহর মতে- ‘‘ইবনে তাইমিয়াহকে শবে বরাতের রাতে নফল নামায আদায় বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, যদি মানুষ শবে বরাত রাতে একাকী অথবা বিশেষ জামাত সহকারে নফল নামাজ আদায় করে, যেমনিভাবে সালফে ছালেহীনগণের অনেকেই করতেন, তাহলে তা খুবই ভাল কাজ’’। তিনি অন্যত্র বলেন, শবে বরাতের ফজিলতে অনেক হাদিস ও রিওয়ায়েত বিদ্যমান এবং এটাও প্রমাণিত যে, সালফে সালেহীনগণ এ রাতে বিশেষ নফল নামায আদায় করতেন। সুতরাং একাকীভাবে এ রাতে ইবাদতের ক্ষেত্রে সালফে ছালেহীনগণ অগ্রগামী এবং এতে নির্ভরযোগ্য প্রমাণও মিলে। সুতরাং এ ধরনের বিষয়ে অস্বীকার করা যায় না। (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া: ৩/ ১৩১-১৩২)
আল্লামা মুবারকপুরী: তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তোহফাতুল আহ্ওয়াজী’তে বলেন- জেনে রেখো, শাবানের মধ্যরাতের (শবে বরাতের) ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে, সব হাদিস একত্রিত করলে প্রমাণিত হয় যে, এ রাতের ফজিলতের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। অনুরূপভাবে এ হাদিসগুলো সম্মিলিতভাবে তাদের বিপক্ষে প্রমাণ বহন করে যারা ধারণা করে যে, শবে বরাতের ফজিলতের ক্ষেত্রে কোন প্রমাণ মেলে না।’’
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ’লাতায়েফুল মা’রেফ’ নামক কিতাবে বর্ণনা করেন- শাবানের মধ্যরাতকে শামবাসী তাবেয়ীগণ অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং ইবাদত-বন্দেগীতে রত থাকতেন। খালেদ বিন মা’দান, লোকমান বিন আহমরসহ শামদেশীয় তাবেয়ীগণও মসজিদে গিয়ে শবে বরাত পালন করতেন। এবং ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাভীয়াও এতে ঐক্যমত পোষণ করেছেন এবং সমর্থন দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন ‘‘মসজিদে সমবেত হয়ে জামাতসহকারে এ রাত উদ্যাপন করা বিদ‘আত নয়। (বরং সুন্নাত) তিনি আরো বলেন: “সিরিয়াবাসী তাবেয়ীনদের কাছ থেকে মানুষ এ রাতের ফজিলত এবং মর্যাদার বিষয়টি গুরূত্বসহকারে গ্রহণ করেছেন। তিনি আরো বলেন: এ রাত জামাত সহকারে মসজিদে উদ্যাপন করা মুস্তাহাব। হযরত খালিদ ইবনে মা’দান এবং লোকমান ইবনে আমেরসহ অন্যান্য তাবেয়ীগণ এ রাতে উন্নতমানের পোশাক পরিধান করতেন, খুশবু লাগাতেন, সুরমা দিতেন এবং এ রাতটি সম্পূর্ণরূপে মসজিদে কাটাতেন। ইমাম ইসহাক ইবনে রাহাভিয়াও এটার সমর্থনে বলেছেন- ‘জমাত সহকারে এ রাতটি মসজিদে উদ্যাপন করা বিদ‘আত নয় (হারব আল কেরমানী তাঁর ‘আল্ মাসায়েল’ নামক কিতাবে তা বর্ণনা করেছেন) তিনি আরও বলেন: ‘‘বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজীয বসরায় নিযুক্ত গভর্ণরের কাছে এ মর্মে চিঠি লিখলেন যে, বছরের চারটি রাতকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেবে। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা এ রাতগুলোতে রহমতের অঢেল প্রবাহ দান করেন। এগুলো হলো- রজবের প্রথম রাত, শাবানের মধ্য রাত এবং উভয় ঈদের দুই রাত।’’ (ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী:’লাতায়েফুল মা’রেফ’ ২৬৩)
হযরত আত্বা ইবনে ইয়াসার বলেন: ক্বদরের রাতের পর বরাতের রাতের চেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ রাত আর কোনটি হতে পারে না। এ রাতে আল্লাহ্ সর্বশ্রেণীর লোকদের ক্ষমা করে দেন। একমাত্র মুশরিক, ঝগড়াটে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীকে ব্যতিরেকে। তিনি আরও বলেন: ‘‘যখন শাবানের মধ্য রাত উপস্থিত হয়, তখন মালাকুল মাওত এর কাছে একটি রেকর্ডবুক অর্পণ করে এ নির্দেশ দেয়া হয় যে, এ বইয়ে যাদের নাম উল্লেখ রয়েছে তাদের প্রাণ কবজ কর। দেখা যায় মানুষ গাছ লাগাচ্ছে, বিবাহ করছে, ঘর নির্মাণ করছে, অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। আর মালাকুল মাওত একমাত্র নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই জান কবজ করে নেয়।’’ দেখনু: ’লাতায়েফুল মা’রেফ’ লিখক: ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী (৭৩৬-৭৯০) প্রকাশ: কায়রো, পৃ. ১৭৭-২০৩)
উপরিউক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই সর্বপ্রথম শবে বরাত উদ্যাপন করেন এবং তাঁরই অনুসরণে যুগে যুগে মুসলমানগণ এ রাতকে বরকতময় রজনী হিসেবে পালন করে আসছেন। বিশেষ করে তাবেয়ীনদের যুগে এ রাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে মসজিদে সমবেত হয়ে জামাত সহকারে আদায়ের প্রচলন শুরু হয়। আর তাঁরা হলেন সর্বশ্রেষ্ট যুগের মানুষ এর দলভুক্ত। তাই প্রিয়নবী প্রবর্তিত এ ইবাদতকে বিদ‘আত বলা প্রিয়নবীর বিরোধীতারই শামিল।
[ad_2]
Source link